গণপিটুনিতে নিহত সেই রুপলালে মেয়ে নুপুরের বিয়ে আজ
Published : ১৮:৩৮, ২ নভেম্বর ২০২৫
বাবা নেই, বাবা হারানোর যন্ত্রণা হৃদয়ে হা—হা কার করছে। তবুও বাড়িতে চলছে বিয়ের প্রস্তুতি। সাজানো হয়েছে গেট ও প্যান্ডেল। দু’দিন আগে থেকেই কাজ শুরু করেছেন ডেকোরেটর শ্রমিকরা। বরযাত্রী ও আত্মীয়স্বজনদের আপ্যায়নের জন্য ক্রয় করা হয়েছে তিনটি খাসি।
এই সব আয়োজন চলছে গণপিটুনিতে নিহত রুপলাল রবিদাসের মেয়ে নুপুর রবিদাসের বিয়েকে কেন্দ্র করে। আজ ২ নভেম্বর রবিবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে বাবা হারানো কন্যা নুপুর। মেয়ের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেত গিয়েই নিহত হন তারাগঞ্জের ঘনিরামপুরের রূপলাল রবিদাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ রবিদাস (৩৫)।
বাড়িতে বিয়ের উৎসব হলেও পরিবারের সদস্যদের হৃদয় যেন ডুকরে কাঁদছে। নুপুর রবিদাস বিয়ের সাজে বসলেও তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করার জন্য বাবা রুপলাল রবিদাস পৃথিবীতে নেই। মেয়ের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেত গিয়েই চুরির অপবাদ দিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় তাকে।
এ ঘটনায় তারাগঞ্জের ঘনিরামপুরের রূপলাল রবিদাস ও মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ রবিদাস নিহত হন। এরপর সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের নেতারা পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
তবে বিয়ের আয়োজন সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রুপলাল রবিদাসের পরিবারকে। জানা যায়, রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করতেন রুপলাল রবিদাস। উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের রুপলাল রবিদাসের দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে নুপুর রবিদাস তারাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত।
ছোট মেয়ে রুপা রবিদাস স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। রুপলাল রবিদাসের একমাত্র ছেলে জয় রবিদাস তারাগঞ্জ ওয়াকফ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। অনটনের সংসারে সহযোগিতার জন্য রুপলাল রবিদাসের স্ত্রী ভারতী রানী স্থানীয় জুতা কারখানায় কাজ করতেন।
তবে অসুস্থতার জন্য সেটি বেশি দিন করতে পারেননি। দুই মেয়ে ও এক ছেলের লেখাপড়ার খরচ ও সংসারের ব্যয় মেটানো নিয়ে অনেক পরিশ্রম করতেন রুপলাল। গত ১০ আগস্ট রুপলাল রবিদাসের বাড়িতে মেয়ে নুপুর রবিদাসের বিয়ের দিন—তারিখ ঠিক করার অনুষ্ঠান ছিল।
মিঠাপুকুরের বাসিন্দা জামাই প্রদীপ রবিদাসকে বিয়ের সেই আয়োজনে থাকার জন্য বাড়িতে ডাকেন রুপলাল। এরপর ৯ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে তারাগঞ্জ—কাজিরহাট ছেতরা বটতলায় চোর সন্দেহে রুপলাল ও প্রদীপকে স্থানীয়রা মারধর করে। পরে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে রুপলালের মৃত্যু হয়।
গুরুতর আহত জামাই প্রদীপ পরদিন ১০ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। বাবা ও দুলাভাইয়ের মৃত্যুর পর থমকে যায় নুপুরের বিয়ের আলোচনা। বাবার মৃত্যুর শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠলে পারিবারিক সিদ্ধান্তে রবিবার বিয়ের দিন—তারিখ ঠিক করা হয়।
রংপুর সদর উপজেলার চন্দনপাট ইউনিয়নের কমল রবিদাসের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে নুপুর রবিদাসের। হিন্দু স¤প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী মেয়েকে স্বর্ণালঙ্কার, ঘরসজ্জার সরঞ্জমাদি কেনাসহ বরযাত্রী ও আত্মীয়স্বজন মিলে প্রায় ৪০০ মানুষকে অ্যাপায়নের লক্ষ্যে আয়োজন করেছেন রুপলালের স্ত্রী ভারতী রানী।
পরিবারের অভিযোগ, রুপলালের মৃত্যুর পর প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন ব্যক্তি পরিবারের খেঁাজখবর রাখার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্বাসের মাস না পেরোতেই আর কেউ খেঁাজ রাখেননি অসহায় পরিবারের।
মেয়ে নুপুর রবিদাস বলেন, আমার বিয়ের আয়োজন হলেও মনের ভেতরে বাবা হারানোর কষ্ট রয়ে গেছে। আমার বাবার হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই দেখছে কিন্তু কেউ তাদের নিয়ে কিছু বলে না। পুলিশও তাদের গ্রেফতার করছে না। রুপলালের ছেলে জয় রবিদাস বলেন, বাবা নেই, এই বয়সে আমাকে বিয়ের পুরো কাজ করতে হচ্ছে।
অনেক টাকা—পয়সার দরকার। হাট থেকে খাসি ক্রয় করে এনেছি। জামাই বাবুকে উপহার দেওয়ার জন্য, ঘর সজ্জার সরঞ্জাম কিনেছি। এছাড়া স্বর্ণের আংটি, চেইন, চুড়ি দিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রশাসনসহ কেউ আমাদের খেঁাজ নেয়নি। আমার মামা আমাদের অভিভাবক হিসেবে দেখাশোনা করছেন।
রুপলালের স্ত্রী ভারতী রবিদাস বলেন, আমার ভাস্তি জামাই প্রদীপ রবিদাস পরিবারের অভিভাবকতুল্য একজন ছিলেন। নুপুরের বিয়ের তারিখ ঠিক করা ও হবু জামাইকে কিছু দেওয়ার অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগের দিন আমার স্বামী ও জামাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমার বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।
তারা কীভাবে লেখাপড়া করবে, আমি কীভাবে সংসার চালাব, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি আরও বলেন, মেয়ের বিয়েতে অনেক টাকা লাগছে। এখন ধার—দেনা যেভাবে হোক টাকা জোগাড় করে মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে। যদি কেউ সহযোগিতা করতেন, তা হলে আমাদের উপকার হতো। অনেকেই তো কথা দিয়েছিল কিন্তু এখন তো আর কেউই খেঁাজ করে না।
এদিকে রুপলালের মৃত্যুর পর তার মেয়ে নুপুরের বিয়ের জন্য উপজেলা পরিষদের তহবিল থেকে এক লক্ষ টাকা ও সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুবেল রানা।
তিনি আরও বলেন, রুপলালের মেয়ে নুপুরের পড়াশোনার জন্য শিক্ষাভাতা, তার স্ত্রী ভারতী রবিদাসের জন্য বিধবাভাতা এবং ছেলে জয়লালের ব্যবসার জন্য একটি দোকান ঘরের জায়গা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে ভাগ্নি জামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে নিয়ে ভ্যানে করে রুপলাল রবিদাস বাড়ি ফেরার পথে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাদের পথরোধ করে চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
এরই একপর্যায়ে সন্দেহভাজনরা প্রদীপ লালের কালো ব্যাগ তল্লাশি করে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং কিছু ঔষধ পান। বোতলের ঢাকনা খোলার পর দুর্গন্ধে বুড়িরহাট এলাকার মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতে উত্তেজিত হয়ে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে নিয়ে যান। তাদের দুজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়।
একপর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলাল রবিদাসকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেখান থেকে প্রদীপ লাল রবিদাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। পরদিন ভোরে প্রদীপ লাল রবিদাসেরও মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পরদিন ১০ আগস্ট রূপলাল রবিদাসের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০—৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রংপুর অঞ্চলে বৃষ্টিতে আমান ধান ও সবজির ব্যাপক ক্ষতি
বিডি/এএন
































