গত সোমবার (১০ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার বৈঠক ঘিরে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
বৈঠকের শুরুতেই ট্রাম্প নিজের ব্র্যান্ডের একটি পারফিউম আল-শারাকে উপহার দেন। তবে শুধু উপহারেই থামেননি তিনি—সরাসরি আল-শারার গায়ে পারফিউমটি স্প্রে করে হাস্যরসের সুরে বলেন, “এটাই সবচেয়ে ভালো ঘ্রাণ, আরেকটা তোমার স্ত্রীর জন্য।” মুহূর্তেই উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যান, আর ট্রাম্প আবার মজা করে প্রশ্ন করেন, “কয়জন স্ত্রী তোমার?”
আল-শারা জবাব দেন, “অবশ্যই একজনই।” সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই হেসে ওঠেন। ট্রাম্প তখন রসিক ভঙ্গিতে যোগ করেন, “তুমি জানো না, ভবিষ্যতে কী হয়!”
এই দৃশ্যটি ভিডিওতে ধরা পড়ে এবং মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। কেউ একে ‘অস্বস্তিকর মজার কূটনীতি’ বলছেন, আবার কেউ ট্রাম্পের ‘স্বভাবসুলভ নাটকীয়তা’ হিসেবে দেখছেন।
বৈঠকের মূল আলোচ্য ছিল আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও আইএসবিরোধী অভিযান—কিন্তু ট্রাম্পের পারফিউম পর্বই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ভিডিওটি এক্স (টুইটার), ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে লাখোবার দেখা হয়েছে এবং নানা মিম ও কূটনৈতিক আচরণ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এই বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার মধ্যে আসাদ পতনের পর প্রথম উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ। ২০২৪ সালের শেষ দিকে বাশার আল-আসাদের পতনের পর দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে।
আহমাদ আল-শারা, যিনি একসময় জিহাদি সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতা ও ‘আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি’ নামে পরিচিত ছিলেন, এখন সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
বৈঠকে সিরিয়ার পুনর্গঠন, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পূর্বাঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ট্রাম্প তাঁর পরিচিত ব্যবসায়িক ও নাটকীয় কূটনৈতিক শৈলীতে ব্যক্তিগত রসিকতা, উপহার ও আলাপচারিতার মাধ্যমে বৈঠকটিকে প্রাণবন্ত রাখেন। তাঁর দেওয়া পারফিউমটি ছিল ‘ট্রাম্প ফ্র্যাগ্রেন্স’ ব্র্যান্ডের, যা তিনি ১৯৮০-এর দশক থেকেই বাজারজাত করে আসছেন।
ইসলামিক সংস্কৃতিতে অ্যালকোহলযুক্ত পারফিউম বিতর্কিত হলেও আল-শারা উপহারটি কূটনৈতিক সৌজন্য হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি দামেস্কে ফিরে এক টুইটে যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান, যদিও ‘পারফিউম পর্ব’ সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করেননি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর ছিল সিরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। স্বাধীনতার পর এটি ছিল কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্টের প্রথম হোয়াইট হাউস সফর।
৪৩ বছর বয়সী আল-শারা একসময় আল-কায়েদা-সংযুক্ত এইচটিএস-এর নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি আল-কায়েদায় যোগ দেন ও পরে মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দি হন। মুক্তির পর আসাদবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন তিনি।
২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করে মাথার দাম নির্ধারণ করে ১ কোটি ডলার। তবে ২০১৬ সালে তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এইচটিএস-কে তুলনামূলক বাস্তববাদী সংগঠন হিসেবে পুনর্গঠন করেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাঁর নেতৃত্বে এইচটিএস আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও ইসরাইলের গোপন সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং ইরান-রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত এক নতুন সিরিয়া গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র তাঁর প্রতি অবস্থান নরম করে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং সম্প্রতি তাঁকে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী তালিকা’ থেকেও বাদ দেয়। অনেক কূটনীতিকের মতে, এই বৈঠক কেবল দুই দেশের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি নতুন বাস্তবতার সূচনা।


































