পাকিস্তানে বিতর্কিত ২৭তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর
Published : ১২:৪৪, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বৃহস্পতিবার বহুল আলোচিত ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীতে স্বাক্ষর করে সেটিকে আইনে রূপ দিয়েছেন।
ডন পত্রিকার হাতে থাকা স্বাক্ষরিত সারাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সংবিধান (সাতাশতম সংশোধনী) বিল, ২০২৫—এ প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী সম্মতি প্রদান করা হলো।’
ডনের কাছে থাকা সূত্র জানিয়েছে, সংশোধনী কার্যকর হওয়ার পর যে নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠিত হবে, তার প্রধান বিচারপতিকে আগামীকাল প্রেসিডেন্সিতে শপথবাক্য পাঠ করানো হতে পারে।
সিনেটে অনুমোদন প্রক্রিয়া
সংশোধনীটি সিনেটে দ্বিতীয়বার ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে অনুমোদন পায় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট এতে স্বাক্ষর করেন—যদিও বিরোধী দলগুলো তীব্র আপত্তি জানায়। ভোটের ফল ঘোষণা করে সিনেট চেয়ারম্যান ইউসুফ রেজা গিলানি জানান, বিলের পক্ষে ৬৪টি ও বিপক্ষে ৪টি ভোট পড়েছে।
গিলানি বলেন, ‘সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের কম নয় এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ায় এটি পাস হয়েছে।’ প্রথমে ধারাভিত্তিক ভোট হয় এবং পরে বিভাজিত ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ধারাভিত্তিক ভোটের সময় বিরোধীরা ‘আইনের ধ্বংস’, ‘নামঞ্জুর’ ইত্যাদি স্লোগান দিলে গিলানি এক পর্যায়ে সতর্ক করে বলেন, ‘কোনো স্লোগান নয়।’
বিলটি প্রথম গত সোমবার সিনেটে পাস হয়। এরপর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পাঠানো হলে কিছু সংশোধনীসহ তা অনুমোদিত হয়। সেসব পরিবর্তনের কারণে সংশোধিত বিলটি আবার সিনেটে ফেরত পাঠানো হয়, যেখানে আজ পুনরায় তা পাস হয়। আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার আবার বিলটি উপস্থাপন করেন।
সংশোধনীর প্রধান বিষয়
বিলের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি (সিজেপি) তার মেয়াদকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত একই পদে থাকবেন। তিনি অবসর নিলে সুপ্রিম কোর্ট ও নবগঠিত ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের সিনিয়রতম বিচারক সিজেপির দায়িত্ব নেবেন। মন্ত্রী আরও জানান, সংশোধিত ধারায় সিজেপিই প্রেসিডেন্ট, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অডিটর জেনারেলকে শপথ পড়াবেন।
রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কিত সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় মন্ত্রী বলেন, নতুন পাঠ অনুযায়ী কোনো আদালত—ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট—সংবিধান বাতিলের কোনো পদক্ষেপকে বৈধতা দিতে পারবে না। তার যুক্তি, এটি সামরিক শাসনের পথ রুদ্ধ করা এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা।
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
সংশোধনীর তীব্র সমালোচনা করেন পিটিআই সিনেটর আলি জাফর। তার ভাষ্য, সরকার দ্রুত একটি সাংবিধানিক আদালত গঠন করতে চাইছে—যেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের এই তৎপরতার পেছনে উদ্দেশ্য হলো ‘একজনকে’ ঠেকানো, যিনি অদূরের কারাগারে রয়েছেন।
তিনি আরও মন্তব্য করেন, ২৭তম সংশোধনী ‘প্রতারণা ও ছলচাতুরির’ ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং এতে জনগণের সমর্থন নেই। তার মতে, এই কাঠামোর ভিত দুর্বল, যা একসময় ভেঙে পড়বে।
বিলটির মাধ্যমে একটি ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত স্থাপন এবং সামরিক নেতৃত্ব কাঠামোয় কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গোহর আলি খান বলেন, দ্রুত পাস করানোর মাধ্যমে ‘আপনারা গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতাকে ডুবিয়ে দিয়েছেন।’
বিরোধী জোট তেহরিক তাহাফুজ আইনি-এ-পাকিস্তান আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে সারা দেশে আন্দোলনের ঘোষণা করেছে। তারা জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে সংবিধানে এই ‘অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিপজ্জনক’ পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি ও আইনজীবীরাও সংশোধনীর বিরোধিতা করেছেন—বিশেষত এর সুপ্রিম কোর্টে সম্ভাব্য প্রভাবের কারণে।
বিতর্কিত ধারাবাহিকতা
২৬তম সংশোধনী পাসের প্রায় এক বছর পর সরকার আবারও ২৭তম সংশোধনী নিয়ে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে মধ্যরাতের অধিবেশনে পাস হওয়া ২৬তম সংশোধনীর সময়ও তীব্র বিতর্ক হয়েছিল। পিটিআই দাবি করে, তাদের সাতজন এমপিকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভোট নিশ্চিত করার জন্য। বিএনপি-মেংগলও অভিযোগ তোলে যে, তাদের দুই সিনেটরকে চাপ দেওয়া হয়েছিল—যারা শেষ পর্যন্ত দলীয় অবস্থান অমান্য করে ভোট দেন।
২৬তম সংশোধনী আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও রাজধানীতে ২৭তম সংশোধনী আনার গুঞ্জন আরও জোরালো হতে থাকে। জল্পনার অবসান ঘটে ৩ নভেম্বর, যখন বিলাওয়াল জানান—প্রধানমন্ত্রী শাহবাজের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তাদের সমর্থন চেয়েছে। এরপর সরকার অন্য জোটসঙ্গীদের সঙ্গেও আলোচনা চালায় সমর্থন নিশ্চিত করতে।
১১ নভেম্বর ফেডারেল মন্ত্রিসভার অনলাইন বৈঠকে বিল অনুমোদনের কিছু ঘণ্টার মধ্যেই এটি সিনেটে তোলা হয়। পরদিন সংসদীয় কমিটি খসড়ায় সামান্য পরিবর্তন এনে অনুমোদন দেয়। ১০ নভেম্বর সিনেটে ভোটে ৬৪ ভোটে বিলটি পাস হয়। বিরোধীরা উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে ওয়াকআউট করে। বিরোধী শিবিরের দুই সদস্য দলীয় অবস্থান উপেক্ষা করে বিলের পক্ষে ভোট দেন।
১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদেও বিলটি পাস হয়, যেখানে প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে কিছু সংশোধন যোগ করা হয়। ৩৩৬ সদস্যের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ নিশ্চিত করতে ২২৪ ভোট প্রয়োজন হলেও সরকার পায় ২৩৪ ভোট। জেইউআই-এফের চার সদস্য এর বিরোধিতা করেন। পিটিআই সদস্যরা ওয়াকআউট করে পুরো প্রক্রিয়া বর্জন করেন। নতুন পরিবর্তন যুক্ত হওয়ায় বিলটি আবার সিনেটে পাঠানো হয় এবং আজ এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে।
সূত্র : ডন
বিডি/এএন


































