দশ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার খায়েসের অর্থই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ
Published : ২০:০৮, ২ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলকে খুশি করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। সুতারাং সংস্কার ও বিচার বাদ দিয়ে শুধু নির্বাচন দিলে সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা হবে না।
রবিবার (২রা নভেম্বর) বিকেলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে আয়োজিত "২৮ অক্টোবর থেকে ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের কালো থাবা ও আগামীর বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ"- শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৮ অক্টোবর জাতির গৌরবের একটি দিন।
এই দিন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আধিপত্যবাদের দোসর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন উৎস্বর্গ করেছে। তাদের আত্মদানের পথ ধরেই চব্বিশের বিপ্লব অর্জিত হয়েছে। পুরোনো ফ্যাসিবাদ আবার আসতে চাইলে আবারো লড়াই হবে; নতুন ফ্যাসিবাদের পরিণতিও বেশি ভালো হবে না।
ডা. তাহের বলেন, জুলাই সনদের বিরোধীতা করার মানে হচ্ছে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এক ব্যক্তির হাতে অসম ক্ষমতা থাকলে ফ্যাসিজমের জন্ম হয়। দশ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েস মানেই একনায়কতন্ত্র কায়েম করে দেশকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে রূপ দেওয়া।
তিনি বলেন, প্রকৃত দেশপ্রেমিক কোনো নেতা বারবার ক্ষমতা চায় না। রবং তারা দায়িত্ব নিতে সাহস করে না। যেখানে দেশের সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে কোনো ব্যক্তি দশ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না, সেখানে বিএনপির আপত্তির উদ্দেশ্য জাতি বুঝে।
দড়ি বেঁধে এনে কেউ বিএনপিকে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই সনদ পড়ে-বুঝেই সব দল স্বাক্ষর করেছে। বিএনপিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাক্ষর করেছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে ঈদের মতো উদযাপন করেছে। এখন তারা আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেছে।
গণভোট কোনভাবেই জাতীয় নির্বাচনের দিন সম্ভব নয় উল্লেখ করে ডা. তাহের বলেন, হাসিনা শহীদ-আহতদের জন্য ব্যথিত না হয়ে মেট্রোরেল ভাংচুরের জন্য কান্নার নাটক করেছে।
একইভাবে বিএনপির কাছে দুই হাজার শহীদ ও ৫০ হাজারের অধিক আহত-পঙ্গুত্ব বরণকারীদের রক্তের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি দামি। তারা দাবি করছে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হলে ৩ হাজার কোটি টাকা বাঁচবে।
অথচ জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ব্যতিত দেশ বারবার পথ হারাবে। শহীদদের রক্তের চেয়ে টাকার অংক কখনো দামি হতে পারে না। তিনি বিএনপিকে শহীদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নভেম্বরের গণভোট আয়োজনে সরকারকে সহেযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, গণভোটে জনগণ যেই রায় দেবে জামায়াতে ইসলামী সেই রায় মেনে নেবে।
তিনি প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি অন্যায়ের কাছে অতীতেও মাথানত করেননি। আশা করছি এখনও কারো কাছে মাথানত করবেন না। আপনার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। সুতারাং আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জুলাই সনদের বাস্তবায়নের জন্য নভেম্বরে গণভোট এবং ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করুন।
সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে ড. ইউনূস জিরো, আর বাস্তবায়ন হলে ড. ইউনূস হিরো। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বিশ্বের কাছে যেমন সম্মানিত এবং গ্রহনযোগ্য জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছেও চিরকাল সম্মানিত এবং গ্রহনযোগ্য হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জননেতা মো. নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারী (ঢাকা-৬ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী) ড. আব্দুল মান্নান।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরের প্রতিটি দিনই ছিল কালো অধ্যায়। সেই কালো অধ্যায়ের ধারাবাহিকতা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তনের জন্য আদর্শিক পরিবর্তনের প্রয়োজন।
নেতার পরিবর্তন নয় নীতিরও পরিবর্তন প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর দুই জন নেতা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছে। হাসিনা তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা অভিযোগ এনে হত্যা করলেও দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। অথচ ঐ সময়ে বিএনপি দলীয় মন্ত্রীরা দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল।
কারণ তাদের নীতি ভালো ছিল না। এজন্যই নেতার সাথে সাথে নীতিরও পরির্বতন প্রয়োজন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ২৮ অক্টোবর বাতিলের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শহীদ হওয়ার একটি স্মরণীয় দিন।
তিনি আরও বলেন, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে মন্ত্রী ছিলেন কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুৎফরজ্জামান বাবর সেদিন তাদের ফোন রিসিভ করেননি। জামায়াতে ইসলামী তখন চারদলীয় জোটের শরিক একটি বৃহৎ দল। কিন্তু সেদিন বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। জামায়াত-শিবিরকে নিঃশ্বেষ করতে তারা আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনকে সুযোগ করে দিয়েছে।
কিন্তু জামায়াত-শিবিরকে নিঃশ্বেস করতে গিয়ে তারা নিজেরাও নিঃশেষ হয়েছে জাতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ সেই সুযোগে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এবং পরবর্তীতে ভারতীয় পরিকল্পনায় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেন, শুধু ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আসলে তা নয়, বরং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।
২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নয় ২০০৬ সালের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে বাংলাদেশে আধিপত্যবাদের দোসর ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের উত্থান শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল সরকার লগি-বৈঠা হত্যাকাণ্ড,
পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড, আল্লামা সাঈদী সহ বিচারিক হত্যার শিকার প্রত্যেক জাতীয় নেতা হত্যার বিচার করবে কিন্তু সরকার সেটি না করে কেবলমাত্র জুলাই গণহত্যার বিচারের কার্যক্রম শুরু করেছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি খুন-গুমের বিচার করতে হবে। গণভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনে নয়, নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট সম্পন্ন করতে হবে। তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন,
আওয়ামী লীগের মতো একাত্তরের চেতনা বিক্রি না করে ১৯৯১ সালের জামায়াতকে দেখুন, ২০০১ সালের জামায়াতকে দেখুন যেই জামায়াতের সহায়তায় ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় বসেছেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় বসেছেন। মজলুম সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর অবদান বিএনপিকে অস্বীকার না করতে তিনি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারী ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন মেজর (অব.) রেজাউল হান্নান শাহিন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা ড. খলিলুর রহমান মাদানী, সাবেক সচিব মাহবুবুর রহমান, কর্ণেল (অব.) হাসিনুর রহমান, কর্ণেল (অব.) জাকারিয়া,
দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সভাপতি অধ্যাপক নুর নবী মানিক, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি (ফেনী-১ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী) এডভোকেট এস.এম কামাল উদ্দিন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল (চট্রগ্রাম-১ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী) এডভোকেট সাইফুর রহমান প্রমুখ।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকির, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর (ঢাকা-৮ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী) এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারী (ঢাকা-৫ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী) মোহাম্মদ কামাল হোসেন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারী মুহাম্মদ শামছুর রহমানসহ মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ।
সভাপতির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ পেশিশক্তি ও অস্ত্র শক্তির বলে জনগণকে পরাজিত করে দেশকে হাইজাক করতে চেয়েছিল। সেই দিন গণতন্ত্র হাইজাক হয়ে ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু হয়। আমরা চব্বিশের ৫ আগস্ট হারানো গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছি।
আগামী দিনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচন। কিন্ত আমরা যদি রাষ্ট্র সংষ্কার করতে না পারি তবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এতে করে পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও আওয়ামী লীগের মতোই দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করবে।
এজন্য ফ্যাসিবাদের পথ চিরতরে বন্ধ করতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রয়োজন। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট দিয়ে জুলাই সনদের আলোকে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। যারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে চায় না তারাও আওয়ামী লীগের মতো জনগণকে উপেক্ষা করে নিজেদেরকে দেশের মালিক মনে করে।
বিডি/এএন































