পাকিস্তানের সীমান্ত বন্ধ, হরমুজ প্রণালী ঘিরে জ্বালানি সংকটের শঙ্কা

Published : ১২:৫১, ১৭ জুন ২০২৫
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান সামরিক সংঘাতে অঞ্চলজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে যখন পাকিস্তান ইরানের সঙ্গে তার ৫টি সীমান্ত পথ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে।
একই সময়ে ইরান হুমকি দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করবে, যার ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্নের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাকিস্তানের সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাদির বখ্শ পিরকানি জানান, চাগাই, ওয়াশুক, পাঞ্জগুর, কেচ ও গাদার- এই ৫টি জেলার সীমান্তপথে সব ধরণের যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে।
স্থানীয় সীমান্ত কর্মকর্তা আতাউল মুনিম জানান, “ইরানে প্রবেশ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। তবে যেসব পাকিস্তানি নাগরিক ইরানে অবস্থান করছেন, তারা দেশে ফিরতে পারবেন।”
তিনি আরও জানান, সীমান্ত বাণিজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে তা সীমিত পর্যায়ে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। আজ অন্তত ২০০ জন পাকিস্তানি শিক্ষার্থীর ফেরার কথা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে একদিকে যেমন নিরাপত্তাগত উদ্বেগ রয়েছে, অন্যদিকে ইরানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। বেলুচিস্তান অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার জন্য পরিচিত, যা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: পারস্পরিক হামলা ও ক্ষয়ক্ষতি
গত শুক্রবার শুরু হওয়া সংঘর্ষে ইসরায়েল একযোগে বিমান, ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ইরানের বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায়। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি এবং তেল শোধনাগারসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হামলায় এখন পর্যন্ত ইরানে অন্তত ২২০ জন নিহত এবং প্রায় ৯০০ জন আহত হয়েছে।
জবাবে ইরানও তেলআবিবসহ বিভিন্ন ইসরায়েলি অঞ্চলে পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ২৪ জন ইসরায়েলি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ইরানের প্রায় ১২০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করেছে, যা দেশটির হামলা সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করেছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন দাবি করেন, “আমরা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস করে দিয়েছি। শুধু গত রাতেই ২০টির বেশি লঞ্চার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”
হরমুজ প্রণালী নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ
সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইরান হুমকি দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে- যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক গভীর সংকেত। এই প্রণালীর মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ তেল সরবরাহ হয়, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদক দেশগুলোর জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুট।
যদিও সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর বিকল্প পাইপলাইন রয়েছে, যেমন- সৌদির আবকাইক থেকে ইয়ানবু পর্যন্ত ৭০ লাখ ব্যারেল ক্ষমতার পাইপলাইন এবং আমিরাতের ফুজাইরাহ বন্দরে গমনযোগ্য ১৫ লাখ ব্যারেল ক্ষমতার পাইপলাইন- তবুও এসব বিকল্প হরমুজ প্রণালী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হলে চাহিদা মেটাতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধের ফলে চীন, ভারতসহ এশীয় তেল আমদানিকারক দেশগুলো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। এমনকি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনও চায় না এই পথ বন্ধ হোক, কারণ এখান দিয়ে তাদের অধিকাংশ জ্বালানি আসে।
ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান পুরোপুরি প্রণালী বন্ধ না করলেও আংশিক নাশকতা, ড্রোন হামলা বা সামুদ্রিক হুমকির মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এর আগে ১৯৮০-র দশকে 'ট্যাঙ্কার যুদ্ধ' চলাকালে এই পথেই ৪৫০টির বেশি জাহাজে হামলা হয়েছিল, কিন্তু প্রণালী পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
অন্যদিকে, ইসরায়েল এই সংঘাতে সরাসরি হরমুজ প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল নয়, কারণ তাদের তেল আমদানি হয় ভূমধ্যসাগর হয়ে- আজারবাইজান, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, গ্যাবন ও নাইজেরিয়া থেকে।
যদিও এই সংঘাত দুই দেশের মধ্যকার, তবে এর প্রভাব পাকিস্তান থেকে শুরু করে চীন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে কূটনৈতিকভাবে এই সংকট নিরসনে বিশ্বনেতাদের উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
সূত্র: এএফপি, বিবিসি, আইআরএনএ
বিডি/ও