ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান না ড. ইউনূস: মান্না

Published : ১৫:০৩, ২৬ মে ২০২৫
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় আর বাড়বে না এবং নিজের ক্ষমতাও দীর্ঘায়িত করতে চান না- রাজনৈতিক দলের নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেছেন, এপ্রিলের পর কোনোভাবেই আর সময় গড়াবে না।
রোববার (২৫ মে) রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এমন কথা বলেন মুহাম্মদ ইউনূস। রাজধানীর হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি নিবাস যমুনায় দুই পর্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিকেলে বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দুই পর্বে বৈঠকে বসেন ড. ইউনূস।
প্রথম পর্বে বিকেল ৫টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন- লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সেক্রেটারি সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়কারী টিপু বিশ্বাস, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
এরপর দ্বিতীয় দফায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়।
বৈঠকে ছিলেন- হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জাতীয় নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার এবং ইসলামী ঐক্য জোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি।
বৈঠক শেষে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বুঝিয়েছি—আপনার বেশি করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করতে হবে, কথা বলতে হবে, মতবিনিময় করতে হবে। আপনি কেমন করে নির্বাচন করতে চান, তা সবার সঙ্গে শেয়ার করবেন। আপনার সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে কোনটা সংস্কার না করলেই নয়। সংস্কারের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হলে নির্বাচন বিলম্ব হবে। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, এপ্রিলের পর কোনোভাবেই আর সময় গড়াবে না।
তিনি বলেছেন, আমি কোনোভাবেই চাই না আমার ক্ষমতা আরও দীর্ঘায়িত করতে। উনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় আর বাড়াতে চান না।
এ সময় সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা বলেছি, জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যদি আমরা সংস্কার কাজে এগিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে সেটাই হবে আসল সংস্কার।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে সহজভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম একটি সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। আপনার ওপর যে মানসিক নির্যাতন চলছে তা আমরা অনুভব করছি। আমরা উনাকে (ড. ইউনূস) স্পষ্টভাবে জানিয়েছি—আপনি যদি পরাজিত হন, তাহলে আমরাও পরাজিত হবো। কিন্তু মাঝপথে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে রেজাউল করীম বলেন, কারও মতে ডিসেম্বর, আবার কেউ বলছেন মার্চ। তবে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন ২০২৬ সালের জুনের ৩১ তারিখের পরে তারা আর থাকবেন না। এতে আমাদের ভেতরে থাকা কিছু ভয় কেটে গেছে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের ব্যাপক সন্দেহ, সংশয়, দূরত্ব (গ্যাপ) ও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। নবগঠিত দল এনসিপির সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বয়হীনতা লক্ষকরা গেছে। এমনকি গণঅভ্যুত্থানের কিংমেকার ছাত্রসমাজের মধ্যে যে বিভাজন রেখা পরিলক্ষিত হয়েছে, সে ব্যাপারে সরকার নির্বিকার থেকেছে। এটা ক্রমেই সরকারের সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলেছে। মূলত, নির্বাচন ডিসেম্বরে করতে কী সমস্যা। অনিবার্য কারণে জুন পর্যন্ত সময় লাগলেই বা অসুবিধা কী। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির কাছে জনগণ এর ব্যাখ্যা জানতে চায়। আশা করি, উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরবেন।
মঞ্জু আরও বলেন, মনে হচ্ছে সিভিল ও সামরিক প্রশাসনের ওপর সরকারের এখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। এ অবস্থায় শুধু আহ্বান, বৈঠক বা আশা পোষণ জাতীয় বিবৃতি দিয়ে সংকটের সমাধান হবে না। আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে বা পুরো উপদেষ্টা পরিষদ পদত্যাগ করলেও কোনো লাভ হবে না, বরং দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। আমরা মনে করি, বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সঠিক উপলব্ধি, ছাড় দেওয়ার মনোভাব প্রদর্শন, ইগো পরিত্যাগ ও সমঝোতামূলক পদক্ষেপই উত্তম সমাধান। সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব গ্যাপ ও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তা সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমাদের পরাজয় বা পিছু হটার কোনো পথ নেই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, যেসব বিষয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত এবং সংবেদনশীল বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথা বলেছি। ভবিষ্যতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্যই রেখে দেওয়া উচিত। আমরা বলেছি, স্বল্পতম সময়ে বিচারকে দৃশ্যমান করবেন। সংস্কার ইস্যুতে আমরা যেসব বিষয়ে একমত হয়েছি, সেসব বিষয়ে আলোচনা করে আগামী এক মাসের মধ্যে একটি সনদে আমরা স্বাক্ষর করতে চাই। নির্বাচন প্রশ্নে বলেছি, দেশের মানুষ ১৬ বছর ধরে দেশে একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, আমরা ইউনূসকে বলেছি পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তিনি যাতে মাঝপথে হাল ছেড়ে না দেন। তিনি দেশ এবং জাতিকে একটি গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েই তার দায়িত্ব ক্ষান্ত দেবেন। তিনি একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে চান। ২০২৬ সালের জুনের পর এক ঘণ্টাও তিনি আর ক্ষমতায় থাকবেন না। তার আগেই তিনি সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন বলে আমরা তাকে বলেছি।
মামুনুল হক আরও বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী আন্দোলনে শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে চব্বিশের জুলাই পর্যন্ত সব হত্যাকারীকে (শেখ হাসিনাসহ) বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি যাতে সম্পন্ন হয়। প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী করিডোর ইস্যুতে তিনি যাতে কোনো সিদ্ধান্ত না নেন, তা-ও বলেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটি পূরণের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি বৈঠকের কথা বলেছি।
মামুনুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলামের মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন, মামলাগুলোর বিহিত তিনি করবেন; বিষয়টি নিজেই দেখবেন। নারী সংস্কার কমিশনের বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। সরকার আমাদের কথা ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তারা কোরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন বাস্তবায়ন করবেন না বলে আশ্বস্ত করেছেন। নির্বাচন নিয়ে বলেছি, জুনের মধ্যে তিনি নির্বাচন সুসম্পন্ন করবেন। বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে আসীন করার জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। তিনি আমাদের সহায়তা চেয়েছেন।
বিডি/ও