ঈদের দিন মরক্কোতে পশু কোরবানিতে নিষেধাজ্ঞা

Published : ২১:৪৭, ৫ জুন ২০২৫
এবার ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির ওপর রাজকীয় ডিক্রি (সরকারি আদেশ) জারি করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আফ্রিকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মরক্কো।
গত বুধবার (৪ জুন) রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদের (আপনার দেওয়া তথ্যে রাজা পঞ্চম মোহাম্মদের কথা বলা হয়েছে, যা একটি ভুল তথ্য হতে পারে, সাধারণত বর্তমান রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ) জারি করা রাজকীয় ডিক্রিটি পড়ে শোনান দেশটির ইসলাম ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ তৌফিক। এই ডিক্রিতে রাজা সাধারণ মানুষকে এ বছর কোরবানি না দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
মরক্কোর ৯৯ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এই অপ্রত্যাশিত এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্ত পুরো বিশ্বকে অবাক করেছে। কিন্তু কেন এমন কঠিন এবং ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নেওয়া হলো?
সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ: তীব্র খরা ও পশুর ঘাটতি
মরক্কোতে এই কঠোর সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গত ছয় বছর ধরে দেশটি ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে। এই খরার কারণে গবাদি পশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে ভেড়ার সংখ্যা গত ১.৩৮ শতাংশ কমেছে। উপরন্তু, এ বছর বৃষ্টিপাত গড়ে ৫৩ শতাংশ কম হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
পানির তীব্র সংকট এবং চারণভূমির খারাপ অবস্থা পশুখাদ্য ও পানির তীব্র ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে মাংস উৎপাদনও আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে, যা সরাসরি দেশের অর্থনীতি এবং খাদ্য সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মরক্কোর সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে প্রচণ্ড খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে পশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট পশুসম্পদ রক্ষায় এবং কৃষিখাতের স্থায়িত্ব বজায় রাখতেই এমন বিতর্কিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেছেন।
সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন ও কৃষকদের উদ্বেগ
সাধারণ মানুষ যেন এই সরকারি আদেশ অমান্য করতে না পারেন, সেজন্য মরক্কো সরকার বিশেষ নিরাপত্তা ও তদারকি বাহিনীকে প্রস্তুত করেছে। পশু পরিবহনের পথেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কেউ আদেশ অমান্য করে পশু কোরবানি করলে তাকে বিপুল অর্থ জরিমানা এমনকি কোরবানির পশু জব্দ করার ক্ষমতাও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে।
তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তে কৃষকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির একটি কৃষি সংগঠনের প্রধান আব্দেল ফাত্তাহ আমের জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত কৃষকদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এমনিতেই খরার কারণে তারা লোকসানে আছেন। ঈদকে সামনে রেখে পশু প্রস্তুত করে তারা এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু এখন পশু বিক্রি করতে না পারলে তারা আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। তিনি কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সরকারি বাহিনী বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে সাধারণ মানুষের কেনা ভেড়া জব্দ করছে। এই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
অনেকেই বলছেন, তারা এই সরকারি আদেশ কোনোভাবেই মানবেন না এবং ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পশু কোরবানি করবেন।
জনসাধারণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া এবং ধর্মীয় বিতর্ক
কোরবানির উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মরক্কোর জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তকে ধর্মীয় রীতিনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন এবং এর কঠোর বিরোধিতা করছেন। তাদের মতে, ইসলামে নবী ইব্রাহিমের আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠা ও ত্যাগের স্মরণে ঈদুল আজহার সময় কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধান, এবং এতে সরকারের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।
অন্যদিকে, কেউ কেউ দেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপকে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন। তাদের যুক্তি, পশুসম্পদ রক্ষা করা এবং দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জাতীয় স্বার্থে জরুরি।
অর্থনৈতিক সংকট ও আমদানির উপর নির্ভরতা
খরা ও গবাদি পশুর ঘাটতির কারণে মরক্কোয় মাংসের দাম তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে অনেক পরিবারের পক্ষে কোরবানির জন্য পশু কেনা এমনিতেই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ১ লাখ ভেড়া আমদানির জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়াও, গরু, ভেড়া ও উটের উপর থেকে আমদানি শুল্ক এবং ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। তবে, এই পদক্ষেপগুলো মরক্কোর কোরবানির ঐতিহ্যকে পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি।
সব মিলিয়ে মরক্কোর এই রাজকীয় ডিক্রি কেবল একটি ধর্মীয় বিতর্ক নয়, বরং এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। এই সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে এবং এটি মরক্কোর জনজীবনে কেমন পরিবর্তন আনবে, তা সময়ই বলে দেবে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও তুর্কি টুডে
বিডি/ও