সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের ছোঁয়া লাগেনি রংপুরের চামড়ার বাজারে

রংপুর নগরীতে এবার কুরবানির পশুর চামড়া ছিল কম। আমদানি কম থাকায় সক্রিয় ছিল পুরোনো সিন্ডিকেট। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া ক্রয় করেনি আড়তদারসহ বড় ব্যবসায়ীরা।

গত বছরের চেয়ে সরকার এবার ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০ টাকা নির্ধারণ করলেও ন্যায্য দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগ রয়েছে, কৌশলে দরপতন ঘটিয়ে এবারের কুরবানির চামড়ার বাজার নষ্ট করেছে সিন্ডিকেট চক্র। এতে করে গরিব-অসহায় মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে ঈদের পরও। গরুর চামড়ায় কিছুটা দাম মিললেও ছাগলের চামড়ার বাজারে তেমন কদর নেই।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করে পড়েছে লোকসানে। তাদের অনেকেই অল্প লাভে, আবার কেউ কেউ লোকসান মেনে নিয়েই চামড়া বিক্রি করেছেন। 

এদিকে চামড়া যাতে নষ্ট না হয়, সে লক্ষ্যে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। ঈদের দিন থেকে পরের ৪ দিনে আমদানি হওয়া বেশির ভাগ চামড়া আড়তদাররাও সংরক্ষণ করছেন।

চলতি বছর ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম ১৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও রংপুরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে ২০০-৭০০ টাকার মধ্যে। 

কিছু ক্ষেত্রে বর্গফুটের হিসাবে চামড়ার দাম আরও কম পড়েছে। সরকার নির্ধারিত লবণযুক্ত চামড়ার দামের অর্ধেক দামেও চামড়া বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

গত কয়েক বছরের মতো এবারও রংপুরে কোরবানির পশুর চামড়া সস্তা দামে বেচা-কেনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য দাম পাননি কেউ।

হাতেগোনা কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও কোরবানির চামড়ায় মোটা অংকটাই গিলতে হা করে আছেন আড়তদারসহ স্থানীয় বড় ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছর সিন্ডিকেট চক্রের এ রকম কৌশলী ছকে রংপুরে একদিকে কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার আমদানি, অন্যদিকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হচ্ছে চামড়া বিমুখ। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলছেন, বিগত ১০ বছরের মধ্যে দেশে এবার সর্বোচ্চ দরে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে।

গত ১০ জুন মঙ্গলবার নাটোরের চক বৈদ্যনাথ চামড়ার আড়ত পরিদর্শনে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ছাগলের চামড়ার ক্ষেত্রে সরকারি মূল্য মানা হচ্ছে না। এটা আমরা নিজেরাও লক্ষ করেছি। কিন্তু আমরা সে অনুযায়ী সঠিক অ্যাকশন নেওয়ার চেষ্টা করব।

এ বছরের শিক্ষা নিয়ে সামনের বছর থেকে যাতে এটা হয়। তবে গরুর চামড়ার ক্ষেত্রে এই ব্যাত্যয়টা হচ্ছে না। কিছু চামড়া পচে গিয়েছে। এটা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ভুল।

চলতি মৌসুমে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে ঈদের পর অন্তত ১৫ দিন পর্যন্ত কাঁচা চামড়া স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকদের সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে রংপুরের আড়তদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া লবণজাত করে সংরক্ষণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুমে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং এবং বিভিন্ন আড়তে এ বছর কুরবানির ২ লক্ষ ৮২ হাজার গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া ২ লক্ষ ২৪ হাজার পিস। ছাগলের চামড়ার সংখ্যা ৫৮ হাজার পিস।

এর মধ্যে রংপুরে প্রায় ৪০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছেন ব্যবসায়ীরা। গরু-মহিষ ও খাসির এসব চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন তারা।

তবে ঈদ পেরিয়ে গেলেও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়েছে। প্রতিবছর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করে আড়তে দিলেও এবার তাদের দেখা যায়নি।

ফলে বিগত দিনের তুলনায় এবার চামড়া কম সংগ্রহ করতে পেরেছেন আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীরা। চামড়া সংরক্ষণের জন্য সরকার বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করার কথা বললেও কোনো ব্যবসায়ী সেই লবণ পাননি বলে অভিযোগ তাদের।

রংপুর নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টিতে প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০-৭০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫-১০ টাকায়। 

মৌসুমি চামড়া বিক্রেতারা বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া ক্রয় করে আনার পর আড়তদারদের কাছে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি। এতে করে হতাশ তারা।

গাইবান্ধার আব্দুল লতিফ সরকার নামে এক ব্যক্তি বলেন, তার কুরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন মাত্র ২৫০ টাকায়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের কোনো প্রভাব নেই। কম দামে চামড়া বিক্রি করে আমার ক্ষতি না হলেও গরিব-মিসকিনের ঠিকই ক্ষতি হচ্ছে। কারণ কুরবানির পশুর চামড়ার টাকায় তাদের হক রয়েছে। 

নগরীর নিসবেতগঞ্জ এলাকা থেকে ৫০ পিস চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী জয়নাল বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বর্গফুট হিসাবে মাঝারি গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ৭০০-৮০০ এবং বড় গরুর চামড়া এক হাজার টাকা দাম হওয়ার কথা। তারা ওই হিসাবে গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া ক্রয় করেছেন। গাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচসহ ৬৫০ টাকা পড়েছে প্রতি পিস চামড়া। 

কিন্তু আড়তদাররা ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া ক্রয় করতে রাজি না হওয়ায় তাদেরকে মোটা অংকের লোকসান হয়েছে। চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে হলে শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না। দর ঠিকভাবে বাস্তবায়ন, বাজার মনিটরিং, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহায়তার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। না হলে প্রতিবছরই চামড়ার দাম কমবে।

সরকারের বেধে দেওয়া চামড়ার দাম নির্ধারণ শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকায় সিন্ডিকেট বলয় এবারও ভাঙতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ী ও সাধারণ ফড়িয়ারা। ঈদের পর রংপুর নগরীর চামড়া কেনাবেচার সবচেয়ে বৃহৎ এলাকা হাজীপাড়া চামড়াপট্টিতে চোখে পড়েনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিসিকের নজরদারি।

তবে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো ছিল বেশ তৎপর। নজরদারি না থাকায় পুরো চামড়ার বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নেন স্থানীয় কয়েকজন আড়তদারসহ বড় ব্যবসায়ীরা। 

অভিযোগ উঠেছে, তাদের পাতানো ফাঁদে পড়ে প্রতিবছর চামড়ার ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেকেই। এতে একদিকে চামড়ার বিক্রিত অর্থে গরিব-দুঃখীর যে হক তা সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে চামড়া শিল্পের প্রতি মানুষের বাড়ছে অনীহা। স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের দাবি, সিন্ডিকেট রংপুরের মতো মফস্বলে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। 

মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া ক্রয় করতে পারেনি। বড় ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে লবণের দাম বেশি। এর ওপর শ্রমিকের মজুরির কারণে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগের শেষ নেই। একেকজনের একেক রকম অভিযোগ হলেও সবাই শঙ্কিত চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ রকম সিন্ডিকেট আর অশুভ ফাঁদে এই শিল্প দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে। 

যার কারণে প্রতিবছর গরিবের হক ধরাশয়ী হচ্ছে বড় ব্যবসায়ীদের ফাঁদে। এসব অভিযোগ মানতে নারাজ আড়তদারসহ বড় ব্যবসায়ীরা।

তাদের দাবি, এবার সাধারণ লোকজন চামড়ার ভালো দাম পেয়েছেন। দু-এক জায়গায় কম দামে বেচা-কেনা হলে সেটা চামড়ার আকার ও ধরনের ওপর নির্ভর করে হয়েছে। 

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে নাম না প্রকাশের শর্তে চামড়াপট্টি এলাকার প্রবীণ এক ব্যবসায়ী বলেন, এবার গুটিকয়েক চামড়া ক্রয় করেছেন তিনি। তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে সিন্ডিকেট না হলেও অন্তরের চাওয়া-পাওয়ায় মিল ছিল। এ কারণে চামড়ার দাম খুব বেশি ওঠেনি। এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং খারাপ আচরণের কারণে বাইরের বড় ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা এই এলাকায় আসতে পারেন না। এটার প্রভাব পড়েছে চামড়ার দামে। 

রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ স¤পাদক আজগর আলী বলেন, এবার চামড়ার দাম কম হওয়ায় অনেকেই এতিমখানায় অথবা মাদ্রাসায় চামড়া দান করেছেন। ওই সব চামড়া লবণ দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। দাম বৃদ্ধি পেলে ওইসব চামড়া বাজারে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ক্রমাগত লোকসানের ফলে অনেকে চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। আমি নিজেও প্রায় ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। 

সমিতির সভাপতি আফজাল হোসেন বলেন, সিন্ডিকেট করে কী লাভ? এমনিতেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণের বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম তো বেড়েই চলেছে। এত কিছুর মাঝেও ট্যানারি মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, চামড়া ক্রয় করে কোথায় বিক্রি করা হবে, এ নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের ট্যানারিগুলোর মধ্যে হাতেগনা কয়েকটি চালু রয়েছে। যারা চামড়া ক্রয় করেছেন তারা তো লোকসান এড়ানোর চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক।