ফাঁস হওয়া ফোনালাপে বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত: বিবিসির প্রতিবেদন

Published : ১৪:৫২, ৯ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশে গত ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলনের উপর মারাত্মক দমন-পীড়নের নির্দেশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন বলে ফাঁস হওয়া একটি গোপন ফোনালাপের অডিও থেকে জানা গেছে।
এই অডিওটি বিবিসির অনুসন্ধান প্রতিবেদন (বিবিসি আই) দ্বারা যাচাই করা হয়েছে। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান বিচারে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
গত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে চাকরির কোটার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলে ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনার কণ্ঠ শোনা যায়।
এই নির্দেশের ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা হিসেবে বিবেচিত হয়। অডিওটি গত মার্চে ফাঁস হয় এবং এটি জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) দ্বারা রেকর্ড করা হয়েছিল।
বুধবার (৯ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।
ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী (লেথাল ওয়েপন) অস্ত্র ব্যবহার করে, যার ফলে জাতিসংঘের তদন্তকারীদের মতে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়।
ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় যে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে “প্রাণঘাতী অস্ত্র” ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন এবং “যেখানেই তাদের পাওয়া যাবে, সেখানে গুলি করতে হবে”। এই অডিওটি গত মার্চে ফাঁস হয় এবং এটি জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) দ্বারা রেকর্ড করা হয়েছিল।
বিবিসির আই-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাইয়ের এই ফোন কলটি শেখ হাসিনা ঢাকার গণভবন থেকে করেছিলেন বলে জানা গেছে। এই সময়ে বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশের হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনরোষ আরও বাড়িয়ে দেয়। এর পরের দিনগুলোতে ঢাকায় সামরিক-গ্রেডের রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছিল বলে পুলিশের নথিতে উল্লেখ আছে। বিবিসি আই এই অডিওটির সত্যতা যাচাই করেছে এবং অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ইয়ারশট এটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত করেছে যে এটি সম্পাদনা বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়নি।
বিবিসি’র তদন্তে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ৩৬ দিনের বিক্ষোভের সময় শত শত ছবি,ভিডিও ও নথিপত্র বিশ্লেষণে নিশ্চিত করে জানা গেছে, ৫ আগস্ট ঢাকার জাত্রাবাড়ি এলাকায় পুলিশের হামলায় অন্তত ৫২ জন নিহত হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার একটি ঘটনা। প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ৩০ বলা হলেও, বিবিসি’র তদন্তে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ফুটেজ, সিসিটিভি এবং ড্রোন চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেনাবাহিনী এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরপরই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পালিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের গলি এবং মহাসড়কে গুলি করা হয়। পরে বিক্ষোভকারীরা জাত্রাবাড়ি থানায় আগুন ধরিয়ে দিলে ছয় পুলিশ সদস্য নিহত হন।
বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টে সহিংসতায় জড়িত থাকার জন্য ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, “কিছু পুলিশ সদস্য অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল, যা দুঃখজনক। বাংলাদেশ পুলিশ এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেছে।”
পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিচার গত মাসে শুরু হয়েছে। তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার নির্দেশ, সহিংসতায় উসকানি, ষড়যন্ত্র এবং গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। আইসিটি’র পরামর্শক ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বলেন, “এই রেকর্ডিংগুলো তার ভূমিকা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো স্পষ্ট এবং যথাযথভাবে যাচাই করা হয়েছে।”
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ তার প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে, কিন্তু ভারত এখনও এই অনুরোধ পূরণ করেনি। ক্যাডম্যান বলেন, শেখ হাসিনার দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা নিশ্চিত করতে পারি না যে বিবিসি উল্লেখিত টেপ রেকর্ডিংটি সত্য কিনা।” তারা দাবি করেছেন, সরকারের সিদ্ধান্তগুলো সমানুপাতিক এবং জনগণের ক্ষতি কমানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ এখন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থাকবে, যা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং ন্যায়বিচারের পথে প্রভাব ফেলবে। সূত্র: বিবিসি
বিডি/ও