ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা: নিখোঁজ ইউরেনিয়াম মজুত নিয়ে রহস্য বাড়ছে

Published : ২২:২২, ২৪ জুন ২০২৫
গত রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা থেকে অধিকাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম একটি গোপন স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বলে মার্কিন কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
সোমবার (২৩ জুন) ফক্স নিউজের ‘স্পেশাল রিপোর্ট’ অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ব্রেট বাইয়ারের প্রশ্নের জবাবে জেডি ভ্যান্স বলেন, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ৩টি পারমাণবিক স্থাপনার নিচে চাপা পড়েছে।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ৩টি পারমাণবিক স্থাপনার নিচে চাপা পড়েছে।
এর আগে রোববার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানের প্রধান ৩ পারমাণবিক স্থাপনায় 'অত্যন্ত সফল' হামলা চালিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ফোরদো ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, হামলার আগে ইরান হয়তো এই জ্বালানির একটি অংশ সরিয়ে ফেলেছে।
রোববার সকালে রয়টার্সকে ইরানের এক ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা থেকে অধিকাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম একটি গোপন স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এছাড়া স্থাপনাটিতে কর্মরত জনবলও সর্বনিম্ন মাত্রায় নামিয়ে আনা হয়েছিল।
সোমবার (২৩ জুন) ফক্স নিউজের 'স্পেশাল রিপোর্ট' অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ব্রেট বাইয়ার ভ্যান্সকে প্রশ্ন করেন, যুক্তরাষ্ট্র জানে কিনা—ইরানের কাছে থাকা প্রায় ৪০০ কেজি বা ৮৮২ পাউন্ড ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বর্তমানে কোথায় রয়েছে।
প্রশ্নের জবাবে ভ্যান্স বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য ছিল ইউরেনিয়ামকে মাটিচাপা দেওয়া। আমি মনে করি, সেটাই হয়েছে। তবে আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল (ইরানের) ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া ধ্বংস করা এবং সেই সমৃদ্ধ জ্বালানি পারমাণবিক অস্ত্রে পরিণত করার সক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া।'
এটি ৯২ শতাংশ মাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের 'অস্ত্র-উপযোগী' মানদণ্ডের নিচে হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের হাতে থাকা এই পারমাণবিক জ্বালানি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে।
গতকাল সকালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা-র (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সতর্ক করে বলেন, 'এই মুহূর্তে কেউই— এমনকি আইএইএ-ও— ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় মাটির নিচে কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা পুরোপুরি নির্ধারণ করতে পারেনি।'
তিনি জাতিসংঘের এই সংস্থার পরিদর্শকদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার দাবি জানান, যাতে তারা 'যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা যাচাই করতে' পারে।
এদিকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও অনুমান করেই বলছেন, ওই পরমাণু উপকরণের আসলে কী হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
মার্কিন হামলার কয়েকদিন আগেই ম্যাক্সার টেকনোলজিস প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ফোরদো পর্বতের সুড়ঙ্গগুলোর প্রবেশপথের সামনে ১৬টি কার্গো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। লন্ডনের ওপেন সোর্স সেন্টার বিশ্লেষণে বলা হয়, ইরান সম্ভবত আগেভাগেই ওই স্থাপনায় হামলার বিষয়টি টের পেয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
তবে প্রকৃতপক্ষে ওই স্থাপনা থেকে ঠিক কী সরানো হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
রাফায়েল গ্রোসি নিজেই সোমবার জানিয়েছেন, ১৩ জুন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তাকে সতর্ক করে বলেন, তেহরান তার পরমাণু যন্ত্রপাতি ও উপকরণ 'রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা' নেবে।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের 'ক্রিটিক্যাল থ্রেটস প্রজেক্ট'-এর ইরানবিষয়ক প্রধান আনিকা গানজেভেল্ড দ্য পোস্টকে বলেন, 'আমাদের কাছে কিছু ইঙ্গিত আছে, কিংবা অন্তত ইরানিরা বলছে যে, তারা ওই উপকরণ সরিয়ে নিয়েছে বা সরিয়ে ফেলেছিল।'
তিনি বলেন, 'আমার মনে হয়, ইসরায়েলি বিমান হামলার পর ইরান হয়তো ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার আশঙ্কায় ওই ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছে।'
জেমস মার্টিন সেন্টার ফর ননপ্রোলিফারেশন স্টাডিজের জেফরি লুইস বলেন, 'এই ইউরেনিয়াম সহজেই ট্রাক বা ট্রেনে করে ইরানের ভেতরে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পাঠানো যায়। এক জায়গায় এটি উৎপাদিত হয়, পরে তা সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়, এরপর অন্য কোথাও নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।'
ভ্যান্সের ধারণা সঠিক হয়ে থাকলে এবং ইউরেনিয়াম মাটির নিচে গোপনে রাখা হয়ে থাকে, তাহলেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ কমছে না।
গানজেভেল্ড বলেন, যদি ইউরেনিয়াম থেকে গিয়ে থাকে, তাহলে সেটি হামলার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে এবং ইরান মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনা কেটে যাওয়ার অপেক্ষা করতে পারে।
তিনি বলেন, 'যদি ইরান প্রকাশ্যে মাটির ওপরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধের ঘোষণা দেয়, তবু গোপনে সেই ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিতে পারে—এই আশঙ্কাই বড় বিষয়।'
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক হার্লি লিপম্যান আরেকটি আশঙ্কার কথা বলেন। তিনি বলেন, ইরান হয়তো ইউরেনিয়াম কোনো শত্রু রাষ্ট্রের কাছে সরিয়ে রেখেছে।
'এটা আবারও লুকানো হতে পারে। রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়া ইরানকে সাহায্য করতে পারে পারমাণবিক কর্মসূচি পুনর্গঠনে,' বলেন লিপম্যান। তিনি বলেন, 'সম্ভবত ইরানের জন্য এসব দেশেই ইউরেনিয়াম মজুত রাখা হচ্ছে।'
আরও ভয়ংকর একটি আশঙ্কার কথাও উঠেছে—ইউরেনিয়াম হয়তো গোপনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যারা এটি দিয়ে 'ডার্টি বোম্ব' বানাতে পারে। তবে দ্য পোস্ট-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনজন পারমাণবিক বিশেষজ্ঞই জানিয়েছেন, এই সম্ভাবনা খুবই কম।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক পারমাণবিক বিশ্লেষক স্টিভ নেলসন দ্য পোস্ট-কে বলেন, 'ইরানের ইউরেনিয়াম ৯০ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ না হলে এটি দিয়ে এমন কিছু করা সম্ভব নয়।'
তিনি বলেন, 'সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি ডার্টি বোম্ব আসলে খুব একটা কার্যকর হয় না। এমন বোম্ব তৈরি করতে গেলে সেটা বিশাল আকৃতির হতে হবে।'
তার মতে, 'হাসপাতাল থেকেই পাওয়া যায় এমন রেডিওঅ্যাকটিভ বস্তু, যেগুলো এই ইউরেনিয়ামের চেয়ে এক কোটি গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়—এটা মোটেও অতিরঞ্জিত কথা নয়।'
বিডি/ও