ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও নগরায়ণ: একসঙ্গে এগিয়ে চলা

ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও নগরায়ণ: একসঙ্গে এগিয়ে চলা

মোহাম্মদ শাহরিয়র খান 

Published : ১৩:৪৯, ১২ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও ফার্নিচার শিল্প সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য বিকাশ লাভ করেছে। নগরায়ণের দ্রুত সম্প্রসারণ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উন্নতি এবং আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতি বাড়তি আগ্রহের কারণে বাসস্থান ও কর্মস্থানের নান্দনিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে মানুষের ভাবনা বদলেছে। শুধুমাত্র বিলাসিতা নয়, বরং স্থান ব্যবস্থাপনা, আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত রুচির প্রতিফলন ঘটানোর জন্যও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের গুরুত্ব বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্পের বাজার মূল্য বর্তমানে প্রায় ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র শিল্পও এই প্রবৃদ্ধির ধারায় এগিয়ে চলেছে এবং এটি দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও ফার্নিচার শিল্পের বাজার প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং এটি প্রতি বছর ১০-১২% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় শহরগুলোতে এ শিল্পের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০,০০০ নতুন ফ্ল্যাট নির্মিত হয়, যার ফলে আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইনের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। মানুষের জীবনমানের উন্নতি এবং আধুনিক বসবাসের চাহিদা বাড়ার ফলে কাস্টমাইজড ফার্নিচার, মডুলার ডিজাইন এবং স্মার্ট স্পেস ব্যবস্থাপনার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র সৌন্দর্য নয়, বরং বাড়ির ভেতরের প্রতিটি কোণকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর প্রবণতা বেড়েছে। স্মার্ট হোম সলিউশন, ইনডোর গার্ডেনিং, ন্যাচারাল লাইটিং ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলো এখন ইন্টেরিয়র ডিজাইনের অংশ হয়ে উঠেছে।

বাসাবাড়ির পাশাপাশি বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোতেও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের গুরুত্ব বাড়ছে। কর্পোরেট অফিসগুলো কর্মীদের জন্য আরামদায়ক ও উৎপাদনশীল পরিবেশ তৈরি করতে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দর ও সুপরিকল্পিত কর্মপরিবেশ কর্মীদের ১৫-২০% বেশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে। তাই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অফিস স্পেসের নকশায় উদ্ভাবনী পরিবর্তন আনছে। রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ও হোটেলগুলো গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে এবং তাদের অভিজ্ঞতা উন্নত করতে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মাধ্যমে নতুনত্ব আনছে। সুপারমার্কেট, শপিং মল ও রিটেইল স্টোরগুলোতেও ভিজ্যুয়াল মার্চেন্ডাইজিং কৌশল, ভালো আলো ও রঙের ব্যবহার করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে।

তবে, এই খাতের অগ্রগতি সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা এ শিল্পের টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো দক্ষ জনশক্তির অভাব। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের চাহিদা বাড়লেও এই খাতে প্রশিক্ষিত ডিজাইনার ও কারিগরের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বর্তমানে বাংলাদেশে মাত্র ৫,০০০-৭,০০০ জন পেশাদার ইন্টেরিয়র ডিজাইনার রয়েছে, যেখানে চাহিদা প্রায় ২০,০০০-২৫,০০০ জনের। অনেকেই একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কাজ করেন, যার ফলে মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী ডিজাইন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। দক্ষ ডিজাইনার ও কারিগর তৈরির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন।

উন্নতমানের উপকরণের অভাবও ইন্টেরিয়র শিল্পের বড় একটি বাধা। ভালো মানের কাঠ, ধাতু, সজ্জাসামগ্রী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রায় ৬০%-ই আমদানি করা হয়, যার ফলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। এটি বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য ইন্টেরিয়র ডিজাইন গ্রহণকে ব্যয়বহুল করে তোলে। স্থানীয়ভাবে মানসম্পন্ন উপকরণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে খরচ কমবে এবং এই শিল্প আরও প্রসারিত হবে। পাশাপাশি, টেকসই উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও কমবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার ইন্টেরিয়র শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ডিজাইনাররা এখন অটোক্যাড, স্কেচআপ, রেভিটের মতো ৩ডি মডেলিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে আরও নিখুঁত ও বাস্তবসম্মত ডিজাইন তৈরি করতে পারছেন। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকরা ডিজাইন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তাদের ঘর বা অফিসের চূড়ান্ত রূপ কেমন হবে তা দেখে নিতে পারছেন। এতে করে তাদের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন আনতে সহজ হয়, এবং ডিজাইন নিয়ে বিভ্রান্তি কমে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০% এর বেশি গ্রাহক এখন ডিজাইন চূড়ান্ত করার আগে ভার্চুয়াল সিমুলেশন দেখতে পছন্দ করেন, যা ডিজাইনের নির্ভুলতা বাড়াচ্ছে এবং গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করছে।

বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র শিল্প শুধু দেশীয় বাজারেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বৈশ্বিক বাজারেও প্রসার লাভ করছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, কাঠ ও কারুকাজ আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে। বাংলাদেশের হাতের কাজ করা আসবাবপত্র, নকশাকৃত কাঠের ফ্রেম, বাঁশ ও কাঁথার ডিজাইন করা উপকরণ বিদেশি ক্রেতাদের নজর কাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ফার্নিচার রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্পের বিকাশ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি ওনার্স এসোসিয়েশন (বিডকোয়া) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই সংগঠনটি শিল্পের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদার মান উন্নয়ন, এবং শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিডকোয়ার উদ্দেশ্য হলো ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্পকে একটি সুসংগঠিত ও পেশাদার রূপ দেওয়া, যাতে এটি দেশের অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে পারে। সংগঠনটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা, সেমিনার, এবং বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ডিজাইনার ও কারিগরদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কাজ করে। এছাড়াও, ইন্টেরিয়র ডিজাইনে আধুনিক প্রযুক্তি ও ট্রেন্ডস সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য নিয়মিত কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে শিল্পে যুক্ত নতুন ও প্রবীণ ডিজাইনাররা আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইন তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন।

বিডকোয়া সরকার ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্পের উন্নয়নে নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে চায়। সংগঠনটি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও আইনি কাঠামো উন্নয়নে সরকারের সাথে আলোচনা করে। এছাড়াও, শিল্পের জন্য বিনিয়োগ ও প্রণোদনা বৃদ্ধির জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিডকোয়া স্থানীয় কাঁচামাল উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য কাজ করে, যা শিল্পের খরচ কমাতে এবং স্থানীয় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক। সংগঠনটি স্থানীয় কারিগর ও উৎপাদকদের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি করে তাদের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নয়নে সহায়তা করে। এছাড়াও, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপকরণের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বিডকোয়া বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কাজ করে। সংগঠনটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, কাঠের কারুকাজ, এবং অন্যান্য স্থানীয় ডিজাইনকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও মেলায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও, বিদেশি ক্রেতাদের সাথে স্থানীয় উৎপাদকদের সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। বিডকোয়া গ্রাহকদের মধ্যে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। সংগঠনটি বিভিন্ন প্রচারণা ও কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রাহকদের জানায় যে, ইন্টেরিয়র ডিজাইন কেবল নান্দনিকতা নয়, বরং এটি জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও স্থানের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক। এছাড়াও, গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী ও মানসম্পন্ন ডিজাইন সেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে। বিডকোয়ার কার্যক্রম ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্প একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আগামী দশকে বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র শিল্প ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। নগরায়ণ বৃদ্ধি, মানুষের জীবনমানের উন্নতি এবং ডিজাইনের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি এই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। তবে, এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে—দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে, স্থানীয় কাঁচামাল উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সাশ্রয়ী ও টেকসই ডিজাইন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের নীতিগত সহায়তা এবং বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হলে এই শিল্পের বিকাশ আরও ত্বরান্বিত হবে।

বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র শিল্পের অগ্রগতির সম্ভাবনা প্রচুর, তবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং উদ্ভাবনী ধারণা গ্রহণের মাধ্যমে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইন্টেরিয়র ডিজাইন কেবল নান্দনিকতার বিষয় নয়, এটি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মাধ্যম। সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ইন্টেরিয়র বাজারেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এখনই সময় এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ইন্টেরিয়র শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করার।

লেখক: বোর্ড মেম্বার, নেক্স রিয়েল এস্টেট এবং মেকানিক্স আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিয়র

শেয়ার করুনঃ
Advertisement