শহর হাঁপিয়ে ওঠে, পার্ক প্রতিবাদ করে: পান্থকুঞ্জে নাগরিক প্রতিরোধ

Published : ২০:০৯, ১৫ জুলাই ২০২৫
একটি স্যাঁতসেঁতে দুপুরে, যখন ঢাকার বাতাসে যানজটের ধোঁয়া ও নির্মাণের শব্দ মিশে থাকে, ঠিক তখনই পন্থকুঞ্জ পার্কে নীরব কিন্তু দৃঢ় এক প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ। কোনো রাস্তা অবরোধ নয়, নেই কোনো বিক্ষোভ মিছিল। আছে কেবল গিটার, রংতুলি, পুতুলনাচ আর কবিতা। গত ছয় মাস ধরে শিল্পী, লেখক, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাধারণ নাগরিকরা এই বিপন্ন সবুজ স্থানটিকে রূপ দিয়েছেন এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মঞ্চে। এই সময়ের মধ্যে পার্কটিতে আয়োজিত হয়েছে ৪৫টিরও বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজনগুলোর মধ্যে ছিল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সংগীত, পথনাট্য, আলোচনাসভা, পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক বক্তৃতা, শিশুদের জন্য আর্ট ওয়ার্কশপ এবং মেডিকেল ক্যাম্প। এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বিনোদন নয়, বরং নাগরিক চেতনা জাগানো ও জবাবদিহিতা দাবি করা।
বাংলাদেশ ট্রি প্রটেকশন মুভমেন্টের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব বলেন, “এটা শুধু গাছ বাঁচানোর লড়াই নয়। এটি স্মৃতি, বাতাস, শৈশব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রাম। আমরা আসলে ঢাকার আত্মাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি।” সোনারগাঁও রোডে অবস্থিত এই পন্থকুঞ্জ পার্ক ছিল একসময় রাজধানীর এক বিরল সবুজ আশ্রয়স্থল। দেশি গাছ, পাখি আর ভ্রমণকারীদের পদচারণায় মুখর ছিল এই স্থানটি। তবে একাধিক প্রকল্পের আড়ালে আজ পার্কটি প্রায় নিশ্চিহ্ন। প্রথমে ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ‘সৌন্দর্য বর্ধন’-এর নামে পার্ক ঘিরে দেয় দেয়াল। এরপর আসে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, যা পার্কের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা দখল করে নেয়। এখন যেখানে ঘন সবুজ ছিল, সেখানে শুধুই খালি গর্ত ও কংক্রিট স্তূপ। পড়ে আছে একটি বিশাল বোরিং মেশিন, চারপাশে লোহার বেড়া আর কিছু স্লোগান। এই দখলদারির মাঝেও আন্দোলনকারীরা তৈরি করেছেন এক নতুন সাংস্কৃতিক পরিসর। পার্কজুড়ে দেখা যায় ভাস্কর্য, দেয়ালচিত্র, তাঁবু আর অস্থায়ী মঞ্চ।
পরিবেশবিদদের মতে, শুধু পন্থকুঞ্জ ও ধানমণ্ডিতেই গত এক বছরে কাটা হয়েছে দুই হাজারের বেশি গাছ। সারাদেশে গাছ নিধনের সংখ্যা ৪২০০ ছাড়িয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মাণকাজ চলছে বলে অভিযোগ, কারণ সংশ্লিষ্ট অনুমোদনের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি। গত ডিসেম্বরে তিনজন উপদেষ্টা এলেও, কেবল উদ্বেগ প্রকাশ করে ফিরে যান, কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। তবুও প্রতিবাদ থেমে নেই। প্রতি সপ্তাহেই পন্থকুঞ্জে আয়োজিত হচ্ছে নানা অনুষ্ঠান। শিশু থেকে বৃদ্ধ—অনেকেই এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন। এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, “শিশুরা এখন একে বলে ‘যেখানে গাছওয়ালারা গান গায়’।” রাজীব জানান, এই আন্দোলনের পেছনে রয়েছে সাধারণ জ্ঞান ও সামাজিক বিবেক। তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-সংবেদনশীল শহর। অথচ পার্ক বা জলাধার রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ খুবই কম। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে পার্ক আছে। দক্ষিণে ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৭টিতে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবহার অনুপযোগী বা লিজ দেওয়া।” তিনি আরও বলেন, “আমরা শুধু গাছ কাটার বিরোধিতা করছি না, আমরা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি ঢাকার বাসযোগ্যতা। যদি একটি পাখিও আশ্রয় পায়, একটি শিশুও পরিষ্কার বাতাসে বেড়ে ওঠে—তাহলেই এই আন্দোলন সার্থক।” বাংলাদেশ ট্রি প্রটেকশন মুভমেন্টের আরেক সমন্বয়ক নাইম উল হাসান বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি আন্দোলনটিকে সর্বজনীন করতে, যাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে যুক্ত হতে পারেন। কারণ পরিবেশ ইস্যু শুধু কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়, এটি সবার।” রাজীব জানান, আন্দোলনটি ইচ্ছাকৃতভাবে অহিংস রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, “এটি কেবল প্রতিবাদ নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ নাগরিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আমাদের পাশে আছেন। শিল্প ও সংস্কৃতি মানুষকে এমনভাবে সংযুক্ত করে, যা পরিসংখ্যান দিয়ে সম্ভব নয়।” এই আন্দোলনের মাঝেও নগর কর্তৃপক্ষের দ্বৈত ভূমিকা স্পষ্ট। একদিকে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়, আবার অন্যদিকে পার্কের মধ্যে নির্মাণ করা হয় বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র ও পাবলিক টয়লেট। পানি সরবরাহ সংস্থা, বিদেশি প্রতিষ্ঠান এমনকি বেসরকারি কোম্পানিও পার্কের জমির অংশ দাবি করেছে। প্রাণিকুলের ওপরেও এর প্রভাব পড়েছে। রাজীব জানান, “গত ডিসেম্বরে গাছ কাটার পর পাখিদের ঘোরাফেরা কমে গেছে। ওরা আমাদের আগেই এখানে ছিল। ওদেরও এ জায়গার ওপর সমান অধিকার আছে।” প্রতিবাদের ১৬৮তম দিনে এক গণশুনানির আয়োজন করা হয়।
এতে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ড. ইফতেখারুজ্জামান, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও শামসী আরা জামান। তারা পার্কে চলমান নির্মাণকাজ বন্ধ এবং এটি পুনরায় জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের সাময়িকভাবে অবস্থান কর্মসূচি স্থগিতের অনুরোধ করেন। বর্ষার মেঘ জমলেও থেমে নেই সাংস্কৃতিক আয়োজন। কারণ আন্দোলনকারীদের বিশ্বাস, একটি পার্কের লড়াই আসলে ভবিষ্যতের বাসযোগ্যতার লড়াই।
BD/S