বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার: নিরাপত্তার প্রতীক না কি নতুন প্রশ্নের জন্ম?

Published : ২৩:৩১, ১৬ জুন ২০২৫
আধুনিক আকাশযান প্রযুক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, যেটি এতদিন পর্যন্ত “সবচেয়ে নিরাপদ” বিমানের খেতাব বহন করে এসেছে। এবার সেই বিশ্বাসে বড় ধরনের ধাক্কা।
ভারতের আহমেদাবাদে ঘটে গেল মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা। নিহত হয়েছেন প্রায় ৩০০ মানুষ। কী ঘটেছিল সেদিন?
২০২৫ সালের ১২ জুন। স্থান, ভারতের আহমেদাবাদ বিমানবন্দর। স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে রানওয়ে ছাড়ে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট AI171। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার VT-ANB। গন্তব্য লন্ডনের গ্যাটউইক।
কিন্তু উড্ডয়নের মাত্র ৩০ সেকেন্ড পরই বিমানের পাইলট "মে-ডে" সংকেত পাঠান। এয়ারক্রাফ্টটি তখন মাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায়। পর মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এটি পড়ে যায় শহরের একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
বিমানটি আঘাত হানে একটি চিকিৎসা হোস্টেল এবং স্টুডেন্ট ডরমিটরিতে। আগুন ধরে যায় দ্রুত। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান অন্তত ২৭১-২৮০ জন। বিমানে থাকা যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র বেঁচে যান ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্ওয়াশ কুমার রমেশ।
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার একাধারে অত্যাধুনিক, ইকো-ফ্রেন্ডলি ও সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী বিমানগুলোর একটি। ২০০৯ সালে প্রথম আকাশে ওড়ে এবং আজ অবধি ছিল প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা-মুক্ত। কিন্তু এবার সেই রেকর্ডে ছেদ পড়লো।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, প্রাথমিকভাবে দু’টি GE GEnx ইঞ্জিনেই থ্রাস্ট কমে যায়। সক্রিয় হয় Ram Air Turbine, অর্থাৎ প্রধান শক্তি উৎস- ব্যর্থ হওয়ার ইঙ্গিত। আধুনিক “More-electric” আর্কিটেকচারের এই সমন্বিত ব্যর্থতা বড়সড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ব্যাটারি সমস্যা নিয়ে বোয়িং ৭৮৭ বিশ্বজুড়ে গ্রাউন্ড হয়েছিল। সেবার কিন্তু প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু এবার সেই সৌভাগ্য হয়নি।
ঘটনাটি শুধু ভারতের নয়, বরং বিশ্ব এভিয়েশনের জন্যই বড় ধাক্কা। বোয়িং ৭৮৭-এর মতো উচ্চ প্রযুক্তির বিমানে কিভাবে এমন সমন্বিত ব্যর্থতা ঘটলো, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও, বোয়িং, ভারতীয় ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন এবং আন্তর্জাতিক মহল এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বলেই দেখছে।
নিরাপত্তার প্রতীক না কি নতুন প্রশ্নের জন্ম?
২০০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম উড্ডয়ন এবং ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার মধ্য দিয়ে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার (Boeing 787 Dreamliner) যাত্রা শুরু করে। এর নকশায় ছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন- ৫০ শতাংশ কম্পোজিট উপাদান (বিশেষত কার্বন-ফাইবার), উন্নত "ফ্লাই-বাই-ওয়্যার" কন্ট্রোল সিস্টেম, ৩ স্তর বিশিষ্ট রিডান্ডেন্সি সিস্টেম এবং স্বয়ংক্রিয় স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি, যা বিমানের যান্ত্রিক অবস্থা ফ্লাইট চলাকালীনই পর্যালোচনা করে।
Rolls-Royce Trent 1000 এবং General Electric GEnx-এর মতো উন্নত, জ্বালানি-সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য ইঞ্জিন ব্যবহারের ফলে বোয়িং ৭৮৭ এক দশকের বেশি সময় ধরে “সবচেয়ে নিরাপদ বাণিজ্যিক বিমান” হিসেবে পরিচিত ছিল।
এযাবৎ এটির নামে কোনো প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার রেকর্ড ছিল না। যদিও ২০১৩ সালে ব্যাটারি অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিশ্বজুড়ে এ বিমান সাময়িকভাবে গ্রাউন্ড করা হয়েছিল। তখন ব্যাটারি সিস্টেম রিডিজাইন করে সমস্যা সমাধান করা হয়।
২০২৫ সালের ১২ জুন এই ধারণা প্রথমবারের মতো ভেঙে পড়ে। ভারতের আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইকের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট AI171 (যা একটি Boeing 787-8 Dreamliner VT-ANB) আকাশে ওড়ার মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মাথায় “মে-ডে” সংকেত দেয়। বিমানটি তখন মাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায় ছিল এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্থানীয় একটি মেডিকেল হোস্টেল এবং স্টুডেন্ট ডরমিটরির উপর পড়া বিমানটি আগুনে জ্বলে ওঠে। ফলে বিমানের যাত্রী ও মাটিতে থাকা বাসিন্দাসহ মোট প্রায় ২৭১-২৮০ জনের মৃত্যু হয়। শুধু একজন যাত্রী ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্ওয়াশ কুমার রমেশ, অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
এটি ছিল বোয়িং ৭৮৭ মডেলের প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা এবং ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনাগুলোর একটি।
তদন্তে উঠে আসে বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, উভয় ইঞ্জিনে (GE GEnx) থ্রাস্ট কমে গিয়েছিল এবং একটির কার্যক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায়। বিমানে থাকা Ram Air Turbine (RAT) জরুরি শক্তি উৎপাদনের জন্য সক্রিয় হয়ে যায়, যা নির্দেশ করে যে মূল শক্তি উৎস পুরোপুরি বিকল হয়ে পড়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোয়িং ৭৮৭-এর “more-electric architecture”, অর্থাৎ ইলেকট্রিক-নির্ভর ব্যবস্থাপনা (যেমন, ইঞ্জিন কন্ট্রোল, পাম্প, কুলিং সিস্টেম) সম্ভবত একাধিক ব্যর্থতার সৃষ্টি করে। এমনও আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই আধুনিক ডিজাইনের একটি সংযুক্ত ত্রুটি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমকে একসাথে অকার্যকর করে ফেলে।
পাশাপাশি কিছু বিশেষজ্ঞ ল্যান্ডিং গিয়ার না উঠানো, ফ্ল্যাপ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা বা ককপিটের কোনো মানবিক ভুলকেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে তদন্ত এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ভারতের DGCA, যুক্তরাজ্যের বিমান কর্তৃপক্ষ এবং বোয়িং-এর নিজস্ব টিম একযোগে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার উৎস অনুসন্ধান করছে।
বোয়িং ৭৮৭ এর আগে কখনো কোনো প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় জড়ায়নি। Boeing 737 MAX মডেল যেমন ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুইটি বড় দুর্ঘটনায় ৩৪৬ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, সেখানে ৭৮৭ এতদিন পর্যন্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে “গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড” ছিল। এই দুর্ঘটনা শুধু ৭৮৭ নয়, বরং আধুনিক ইলেকট্রিক-নির্ভর এভিয়েশন সিস্টেমের ওপরই নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
FAA (যুক্তরাষ্ট্র), EASA (ইউরোপ) ও JAA (জাপান) কর্তৃক উচ্চতম নিরাপত্তা অনুমোদনপ্রাপ্ত এই বিমান এখন তদন্তের কেন্দ্রে। ভবিষ্যতে বোয়িং ৭৮৭-এ ব্যবহৃত প্রযুক্তি, বিশেষ করে ইঞ্জিন এবং পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, আরও কঠোরভাবে যাচাই হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা প্রযুক্তির উৎকর্ষ যেমন উন্নততর এভিয়েশন নিশ্চিত করে, তেমনি একটি ক্ষুদ্র ব্যর্থতাও বৃহৎ ট্র্যাজেডিতে পরিণত হতে পারে- যা এই ঘটনাই প্রমাণ করে দিয়েছে।
এই দুর্ঘটনার পর একদিকে যেমন বোয়িং ৭৮৭-এর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূচনা হয়েছে, অন্যদিকে ড্রিমলাইনারের দীর্ঘদিনের “দুর্ঘটনামুক্ত” সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে একবারের দুর্ঘটনা একটি সম্পূর্ণ প্ল্যাটফর্মকে বাতিল করে দেওয়ার যথেষ্ট কারণ নয়। বরং এর মাধ্যমে যে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা উদ্ঘাটিত হয়েছে, তা আগামী দিনের বিমানের ডিজাইন ও অপারেশনাল সিস্টেমে আরও উন্নয়ন সাধনে সহায়তা করবে।
সূত্র: AP News, BBC, CBS news, The Guardian, The New York times
বিডি/ও