‘গণতন্ত্র নয়, বিভ্রান্তি আনবে পিআর পদ্ধতি’—বিশ্লেষণ সালাউদ্দিন আহমেদ

Published : ২০:২১, ১১ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় "নির্দলীয়" বা "অরাজনৈতিক" অবস্থানের ধারণা আদৌ কতটা কার্যকর—সে প্রশ্ন আজ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি শাসনামলে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যেখানে দলীয় আনুগত্য ছাড়া কার্যত কোনো জায়গা নেই। ফলে কেউ সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও, তার অবস্থান হয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে, নয়তো বিপক্ষে—এমন বাস্তবতা আজ সুস্পষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা’র ধারণা কতটা প্রাসঙ্গিক, সে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে বিতর্ক। বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ আরও স্পষ্ট হয়েছে। কেউ চাইছেন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, আবার কেউবা চাইছেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। সাবেক মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সালাউদ্দিন আহমদের ভাষায়, বর্তমানে "নির্দলীয়" বা "অরাজনৈতিক" বলে কিছু নেই। কারণ, পুরো প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামোতেই দলীয় চিন্তা ও অবস্থান এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, নিরপেক্ষতা আজ কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জাতির মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। দ্বিমত আছে গঠনপ্রণালী নিয়ে।
কাদের নিয়ে এই সরকার হবে—এটাই এখন বিতর্কের বিষয়।” এদিকে, বিভিন্ন দল থেকে আনুপাতিক (PR) পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি উঠলেও, সালাউদ্দিন আহমদ তার পক্ষে মত দেননি। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এই পদ্ধতির কোনো রাজনৈতিক চর্চা নেই, ইতিহাসও নেই। আমাদের ভোটাররা একজন পরিচিত ব্যক্তিকে ভোট দিতে পছন্দ করেন। তারা একজনকে চোখে দেখেন, তার কাছে যান। কিন্তু PR পদ্ধতিতে একটি এলাকায় ভোট দিলে দেখা যাবে, সেই এলাকার প্রার্থী নির্বাচিত হবেন না; বরং দলীয় সংখ্যা অনুপাতে কেউ অন্য জায়গা থেকে আসবেন। এতে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে না এবং ভোটারদের আগ্রহও কমে যাবে।” তিনি আরও বলেন, “এই পদ্ধতির বড় একটি সমস্যা হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনো জায়গা থাকবে না। কেউ যদি নির্দলীয় হয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন, কিন্তু কোনো দলে না থাকেন—তাহলে তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না।” আনুপাতিক পদ্ধতিতে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতে পারে ঠিকই, তবে তাতে সরকার গঠনের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তিনি। “এই পদ্ধতি চালু হলে সবসময় কোয়ালিশন সরকার হবে, ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে। ফলে কার্যকর সরকার গঠন অসম্ভব হয়ে পড়বে,” বলেন সালাউদ্দিন আহমদ।
একই আলোচনায় তিনি আপার হাউজ নিয়ে দলের প্রস্তাবনার কথাও তুলে ধরেন। সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে, আপার হাউজে প্রতিনিধিত্ব হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার গুণী ব্যক্তিদের দিয়ে। তবে আপার হাউজ যদি সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার পায়, তাহলে সেটি অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন। সবশেষে, নির্বাচনের সময়সীমা ও সম্ভাব্য সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রাজনীতি সবসময়েই কিছুটা রূপক, কিছুটা রেটোরিক। কেউ যদি বলে সংস্কার না হলে নির্বাচনে যাব না, সেটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। তবে আমরা এখন সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আছি। সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। যদি কেউ মনে করে তারা সুবিধা করতে পারবে না, তাই নির্বাচন বর্জন করছে—তাহলে সেটাও তাদের অধিকার।” সালাউদ্দিন আহমদের বক্তব্যে স্পষ্ট—বাংলাদেশে নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের কাঠামো কেবল আইন বা নিয়ম দিয়ে নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সামাজিক বাস্তবতা এবং জনগণের সচেতনতা দিয়েও নির্ধারিত হয়। তাই “নির্দলীয়তা”র মতো ধারণা যদি বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে, তবে তার পরিবর্তে গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার দিকেই মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
BD/S