ই-লার্নিং: বাংলাদেশের শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশে এক নতুন দিগন্ত

ই-লার্নিং: বাংলাদেশের শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশে এক নতুন দিগন্ত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

Published : ১৩:৪০, ৬ জুলাই ২০২৫

একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরেই আমূল পরিবর্তন আনছে, আর শিক্ষা খাতও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশে ই-লার্নিং বা ডিজিটাল শিক্ষা পদ্ধতি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা শুধু প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবেই কাজ করছে না, বরং দক্ষতা উন্নয়ন এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার ক্ষেত্রেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। মোটকথা, ই-লার্নিং বাংলাদেশের শিক্ষা ও জীবনধারায় এক সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ই-লার্নিংয়ের প্রাসঙ্গিকতা: কেন এটি অপরিহার্য?

ই-লার্নিং হলো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ বা প্রদান পদ্ধতি, যেখানে ইন্টারনেট, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। এটি অনলাইন কোর্স, ভিডিও টিউটোরিয়াল, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, ই-বুক এবং ইন্টারেক্টিভ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশে ই-লার্নিংয়ের প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। 

এর প্রধান কারণগুলো হলো:

শিক্ষার সহজলভ্যতা: প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ততম জীবন পর্যন্ত, ই-লার্নিং শিক্ষার সুযোগকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বা ভৌগোলিক দূরত্ব এখন আর শিক্ষার পথে বাধা নয়।

খরচ সাশ্রয়ী: প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় ই-লার্নিং অনেক বেশি সাশ্রয়ী হতে পারে। যাতায়াত খরচ, আবাসন খরচ এবং অনেক সময় বইপত্র কেনার ব্যয়ও কমে যায়।

সময় ও স্থানের স্বাধীনতা: শিক্ষার্থীরা নিজেদের সুবিধা মতো সময়ে, নিজেদের পছন্দ মতো স্থানে পড়াশোনা করতে পারে। এটি বিশেষ করে কর্মজীবী, গৃহিণী এবং যাদের নির্দিষ্ট সময়সূচিতে ক্লাস করা সম্ভব নয়, তাদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।

ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষা: ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের শেখার গতি ও ধরন অনুযায়ী ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষা প্রদানের সুযোগ তৈরি করে, যা প্রথাগত ক্লাসরুমে প্রায়শই সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ই-লার্নিংয়ের প্রভাব

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ই-লার্নিংয়ের আগমন এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়কালে যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল, তখন ই-লার্নিংই ছিল শিক্ষার একমাত্র ভরসা। এই সময়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার বহু গুণ বেড়ে যায় এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই নতুন এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত হন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য ভিডিও লেকচার, অনলাইন কুইজ এবং অনুশীলনীর সুযোগ তৈরি করেছে। সংসদ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ই-লার্নিংয়ের ব্যবহার আরও ব্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া এবং পরীক্ষার জন্য ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। মুক্তপাঠ, ১০ মিনিট স্কুল, শিক্ষক বাতায়ন-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।

শিক্ষকদের জন্য: ই-লার্নিং কেবল শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, শিক্ষকদের জন্যও নতুন দিগন্ত খুলেছে। অনলাইন প্রশিক্ষণ, ওয়েবিনার এবং শিক্ষক বাতায়নের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।

দক্ষতা বিকাশে ই-লার্নিংয়ের ভূমিকা

একুশ শতকের কর্মবাজারে টিকে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা সব সময় দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজারের চাহিদা মেটাতে পারে না। এক্ষেত্রে ই-লার্নিং দক্ষতা বিকাশের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা: প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা অ্যানালাইসিস, সাইবার নিরাপত্তা—এসব আধুনিক এবং চাহিদা সম্পন্ন দক্ষতা অর্জনের জন্য ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো অপরিহার্য। কোরসেরা (Coursera), ইডেক্স (edX), ইউডেমি (Udemy)-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর পাশাপাশি শিখবে সবাই, ইশিখন, ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট-এর মতো দেশীয় প্ল্যাটফর্মগুলোও তরুণদের জন্য হাজারো কোর্স অফার করছে।

পেশাগত উন্নয়ন: বিভিন্ন শিল্প খাতে কর্মরত পেশাদাররা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা হালনাগাদ করার জন্য ই-লার্নিং কোর্সের সহায়তা নিচ্ছেন। কর্পোরেট প্রশিক্ষণগুলোও এখন অনেকটাই অনলাইনভিত্তিক হয়ে গেছে।

উদ্যোক্তা উন্নয়ন: যারা উদ্যোক্তা হতে চান বা ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন, তাদের জন্য ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, অর্থায়ন, মার্কেটিং এবং সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের মতো বিষয়ে অনলাইনে প্রচুর কোর্স রয়েছে।

ভাষা শিক্ষা: ইংরেজি, চাইনিজ, ফরাসি, জার্মানসহ বিভিন্ন ভাষা শেখার জন্য অসংখ্য ই-লার্নিং অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এর মাধ্যমে ঘরে বসেই আন্তর্জাতিক ভাষা শেখা সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশের জীবনযাত্রায় ই-লার্নিংয়ের আমূল পরিবর্তন

ই-লার্নিং কেবল শিক্ষাব্যবস্থাকেই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। এর কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিচে তুলে ধরা হলো:

জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রসার: ই-লার্নিং মানুষকে শেখার প্রক্রিয়ায় সারাজীবন যুক্ত থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। বয়স বা পেশা নির্বিশেষে যে কেউ যখন খুশি তখন নতুন কিছু শিখতে পারছে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি: ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। অনলাইন শিক্ষক, কনটেন্ট ডেভেলপার, শিক্ষাপ্রযুক্তিবিদ এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবস্থাপকদের মতো পেশাগুলো তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও, ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং বা দূরবর্তী কাজে যুক্ত হতে পারছে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব: ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা গ্রামীণ জনপদেও ই-লার্নিংয়ের বিস্তার ঘটাচ্ছে। কৃষকরা কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারছেন, গ্রামের নারীরা বিভিন্ন হস্তশিল্প শিখতে পারছেন, যা তাদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে।

নারী শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: অনেক নারী যারা প্রথাগতভাবে শিক্ষা গ্রহণ বা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারতেন না, তারা ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসেই শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন। এটি নারীর ক্ষমতায়নে এবং সমাজে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি: ই-লার্নিংয়ের ব্যবহার মানুষকে প্রযুক্তির সাথে আরও বেশি পরিচিত করে তুলছে। এটি সামগ্রিকভাবে দেশের ডিজিটাল সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য।

চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ই-লার্নিংয়ের অপার সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ডিজিটাল বিভাজন, অর্থাৎ ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল ডিভাইসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ইন্টারনেটের গতি কম এবং স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের সহজলভ্যতা সবার জন্য সমান নয়। এছাড়াও, অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা, মূল্যায়নের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোগগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সরকার সারাদেশে ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নত করার পাশাপাশি ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ বিতরণে সচেষ্ট। বেসরকারি সংস্থাগুলো কম খরচে কোর্স প্রদান এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করছে।

ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) প্রযুক্তির ব্যবহার ই-লার্নিং অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষার পদ্ধতি আরও উন্নত হবে এবং শিক্ষার্থীরা আরও বাস্তবসম্মত পরিবেশে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

ই-লার্নিং বাংলাদেশের শিক্ষা এবং দক্ষতা বিকাশের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি শুধু কোভিড-১৯ মহামারীর একটি সাময়িক সমাধান ছিল না, বরং এটি একটি স্থায়ী এবং কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষা সবার জন্য সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং ব্যক্তিগতকৃত হচ্ছে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে এক বিশাল অবদান রাখছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ই-লার্নিং বাংলাদেশের জীবনযাত্রায় আরও গভীর এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে, যা দেশকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করার পথে এক ধাপ এগিয়ে দেবে।

লেখক:

ফাউন্ডার কিনলে ডট কম 
ফাউন্ডিং মেম্বার অফ ই-ক্যাব -৩৩
মোবাইল: ০১৭১৩০১৭৪২৮
ই-মেইল: [email protected]

শেয়ার করুনঃ
Advertisement