শিক্ষা ও উদ্যোক্তা জীবনে দক্ষতা উন্নয়নের অপরিহার্যতা

শিক্ষা ও উদ্যোক্তা জীবনে দক্ষতা উন্নয়নের অপরিহার্যতা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

Published : ১৫:২৪, ৬ জুলাই ২০২৫

বর্তমান বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট– শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি আর সনদের ওপর নির্ভর করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো কঠিন।

"একটাই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ"– এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের উপরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে। 

বিশেষত, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন অপরিহার্য। এই দক্ষতা কেবল ব্যক্তিগত জীবন বা কর্মজীবনের ক্ষেত্রেই নয়, একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। এই প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা, এর বিভিন্ন দিক এবং উদ্যোক্তা জীবনে এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এই দক্ষতা অর্জনে কী ধরনের অবদান রাখছে, সেই বিষয়গুলোও তুলে ধরা হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বনাম দক্ষতা: একটি নতুন সমীকরণ

ঐতিহ্যগতভাবে, আমাদের সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়েছে। ভালো ফল, উচ্চশিক্ষা এবং একটি ভালো চাকরির লক্ষ্যেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তাদের প্রচেষ্টা ব্যয় করেন। কিন্তু আধুনিক শ্রমবাজারের চাহিদা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এখন কেবল মুখস্থ বিদ্যা বা তত্ত্বীয় জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সক্ষম ব্যবহারিক দক্ষতা এবং নতুন কিছু শেখার আগ্রহই কর্মজীবনে সফল হওয়ার পূর্বশর্ত।

আমরা দেখছি, উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার ক্রমবর্ধমান। এর একটি বড় কারণ হলো, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসার বাস্তব চাহিদার সমন্বয়হীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক স্নাতক বের হচ্ছেন, তাদের অনেকেরই শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে না। ফলে চাকরির বাজারে তাদের হিমশিম খেতে হয়। অন্যদিকে, কিছু সুনির্দিষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন মানুষের চাহিদা আকাশছোঁয়া। এই প্রেক্ষাপটে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নকে আর ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে দেখা যাবে না, বরং এটি হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যকীয়।

দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন দিক ও এর অপরিহার্যতা

জীবনে লক্ষ্য অর্জন বা প্রতিষ্ঠিত হতে হলে যে সকল দক্ষতা অপরিহার্য, সেগুলোকে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

১. সফট স্কিলস (Soft Skills):

এগুলো হলো আন্তঃব্যক্তিক এবং ব্যক্তিগত গুণাবলী যা কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এগুলো কোনো নির্দিষ্ট পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও, যেকোনো পেশায় সফল হতে এগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

যোগাযোগ দক্ষতা (Communication Skills): কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে অপরিহার্য। স্পষ্ট এবং সংক্ষেপে কথা বলা, লেখা, শোনা এবং নিজের মতামত সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন এবং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। উদ্যোক্তাদের জন্য, গ্রাহক, বিনিয়োগকারী এবং কর্মীদের সাথে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবসার প্রসারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Problem-Solving & Critical Thinking): যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধান করার ক্ষমতা একজন সফল ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উদ্যোক্তা জীবনে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে, যেখানে দ্রুত এবং সৃজনশীল উপায়ে সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন হয়।

দলগত কাজ (Teamwork): আধুনিক কর্মক্ষেত্রে একা কাজ করার সুযোগ সীমিত। একটি দলের অংশ হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা, অন্যদের মতামতকে সম্মান করা এবং সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন উদ্যোক্তাকে তার কর্মীদের নিয়ে একটি কার্যকর দল তৈরি করতে হয়, যেখানে দলগত সহযোগিতা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়।

অভিযোজন ক্ষমতা (Adaptability): প্রযুক্তি এবং বাজারের চাহিদা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে ইচ্ছুক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। উদ্যোক্তা হিসেবে বাজারের গতিবিধি ও গ্রাহকের চাহিদা বুঝে দ্রুত পরিবর্তন আনার সক্ষমতা ব্যবসার টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।

নেতৃত্বের গুণাবলী (Leadership Skills): নেতৃত্ব কেবল ব্যবস্থাপকদের জন্য নয়, প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে থাকা উচিত। অন্যদের অনুপ্রাণিত করা, নির্দেশনা দেওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার ক্ষমতা পেশাগত জীবনে এগিয়ে নিয়ে যায়। একজন উদ্যোক্তার জন্য কর্মীদের অনুপ্রাণিত করা এবং ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত করার জন্য শক্তিশালী নেতৃত্বের গুণাবলী থাকা জরুরি।

সময় ব্যবস্থাপনা (Time Management): সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষমতা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। উদ্যোক্তাদের জন্য, একাধিক কাজ এবং প্রকল্পের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সময় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।

সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবন (Creativity and Innovation): নতুন ধারণা তৈরি করা এবং প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন পণ্য বা সেবা তৈরি, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর অভিনব সমাধান খুঁজে বের করা এবং বাজারে নিজেকে আলাদা করে তোলার জন্য সৃজনশীলতা অপরিহার্য।

আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া (Intercultural Understanding): বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার প্রসারের কারণে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ বাড়ছে। ভিন্ন সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা এবং শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে কাজ করার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফলতার জন্য জরুরি।

২. হার্ড স্কিলস (Hard Skills):

এগুলো হলো নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য এবং শেখার মতো দক্ষতা যা কোনো নির্দিষ্ট কাজ বা পেশার জন্য প্রয়োজনীয়।

প্রযুক্তিগত দক্ষতা (Technical Skills): ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অপরিহার্য। কম্পিউটার লিটারেসি, মাইক্রোসফট অফিস সুইট, ডেটা অ্যানালাইসিস টুলস (যেমন এক্সেল, এসপিএসএস), কোডিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং – এই সকল দক্ষতা বিভিন্ন পেশায় সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তাদের জন্য, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা, পণ্যের প্রচার, এবং গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য এই দক্ষতাগুলো অপরিহার্য।

ডেটা বিশ্লেষণ (Data Analysis): বিপুল পরিমাণ ডেটা থেকে অর্থপূর্ণ তথ্য বের করার ক্ষমতা আজকাল প্রায় সকল শিল্পের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ডেটা ব্যবহার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ব্যবসার প্রবৃদ্ধি এবং লাভজনকতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। উদ্যোক্তাদের জন্য বাজারের প্রবণতা, গ্রাহকের আচরণ এবং ব্যবসার কর্মক্ষমতা বিশ্লেষণ করার জন্য ডেটা বিশ্লেষণ অপরিহার্য।

আর্থিক ব্যবস্থাপনা (Financial Management): ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা, বাজেট তৈরি, বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং আর্থিক ঝুঁকি বোঝার ক্ষমতা সফলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। উদ্যোক্তাদের জন্য, ব্যবসার তহবিল পরিচালনা, লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ এবং আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য এই দক্ষতা অপরিহার্য।

ভাষা দক্ষতা (Language Proficiency): আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসার প্রসারের জন্য একাধিক ভাষা জানা একটি মূল্যবান সম্পদ। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য সহায়ক।

বিক্রয় ও বিপণন দক্ষতা (Sales and Marketing Skills): যেকোনো পণ্য বা সেবার সফলতার জন্য কার্যকর বিক্রয় এবং বিপণন কৌশল জানা আবশ্যক। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা, তাদের চাহিদা বোঝা এবং পণ্যকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা উদ্যোক্তা জীবনের জন্য অপরিহার্য।

উদ্যোক্তা জীবনে দক্ষতার ভূমিকা ও অপরিহার্যতা

একজন উদ্যোক্তা হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করেন, ব্যবসা শুরু করেন এবং পরিচালনা করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার পথটি মসৃণ নয়; এখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা থাকে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হওয়ার জন্য উপরে উল্লিখিত দক্ষতাগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য:

 দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহস (Vision and Courage): একজন উদ্যোক্তাকে একটি স্পষ্ট ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য ঝুঁকি নেওয়ার সাহস থাকতে হবে। ভয়কে জয় করে নতুন পথে চলার মানসিকতা অপরিহার্য।

স্ব-প্রণোদনা ও শৃঙ্খলা (Self-Motivation and Discipline): উদ্যোক্তা জীবনে কোনো বস থাকে না, তাই নিজেকেই অনুপ্রাণিত করতে হয় এবং কঠোর শৃঙ্খলা মেনে কাজ করতে হয়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরলস পরিশ্রম ও একাগ্রতা জরুরি।

নেটওয়ার্কিং (Networking): সফল উদ্যোক্তারা জানেন যে সঠিক মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন কতটা জরুরি। শিল্প বিশেষজ্ঞ, পরামর্শদাতা, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী এবং গ্রাহকদের সাথে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি ব্যবসার প্রসারে সাহায্য করে।

বিক্রয় এবং দর কষাকষি (Sales and Negotiation): পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং চুক্তি করার ক্ষেত্রে কার্যকর দর কষাকষি দক্ষতা উদ্যোক্তাদের জন্য মৌলিক।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (Risk Management): উদ্যোক্তা জীবনে ঝুঁকি থাকবেই। তবে এই ঝুঁকিগুলোকে চিহ্নিত করা, বিশ্লেষণ করা এবং সেগুলোকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার কৌশল জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা (Customer Relationship Management - CRM): গ্রাহকরাই যেকোনো ব্যবসার প্রাণ। তাদের চাহিদা বোঝা, তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদী সফলতার জন্য জরুরি।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কেবল একটি ভালো আইডিয়া থাকলেই চলে না, সেই আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য বহুমুখী দক্ষতার প্রয়োজন হয়। একজন উদ্যোক্তা একই সাথে বিপণনকারী, বিক্রেতা, হিসাবরক্ষক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক এবং একজন দূরদর্শী নেতা। এসব ভূমিকা পালনে উল্লেখিত সফট ও হার্ড স্কিলসগুলো অপরিহার্য।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের দক্ষতা অর্জনে অবদান

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপাপটে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (Bangladesh Technical Education Board - BTEB) দক্ষতা উন্নয়নে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অবদান অনস্বীকার্য।

ভূমিকা ও কার্যাবলী:

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং উন্নয়নের জন্য গঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:

কারিকুলাম প্রণয়ন ও উন্নয়ন: BTEB শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন ও নিয়মিত আপডেট করে থাকে। এটি নিশ্চিত করে যে শিক্ষার্থীরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করছে, তা যেন বাস্তব কর্মজীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদান: পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফলের ভিত্তিতে ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট প্রদান করে BTEB। এই সনদগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে স্বীকৃতি পেতে সাহায্য করে।

প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি ও মান নিয়ন্ত্রণ: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি প্রদান করে এবং তাদের শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করে। এটি নিশ্চিত করে যে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড বজায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে দক্ষ শিক্ষক অপরিহার্য। BTEB শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে, যাতে তারা আধুনিক প্রযুক্তি ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন।

শিল্পের সাথে সংযোগ স্থাপন: BTEB শিল্পের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কারিকুলাম ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উন্নতি সাধন করে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর সরাসরি শিল্পে কাজ করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

নতুন কোর্স ও ট্রেড চালু: বাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী BTEB নতুন নতুন ট্রেড ও কোর্স চালু করে। যেমন, তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, পোশাক শিল্প ইত্যাদির ওপর বিভিন্ন কোর্স চালু করে যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতি রেখে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, যাতে বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে।

কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও অবদান:

কর্মসংস্থান সৃষ্টি: কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে তৈরি করে, যা তাদের দ্রুত কর্মসংস্থান পেতে সাহায্য করে। প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার তুলনায় কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী সরাসরি কারিগরি পেশায় যোগ দিতে পারে।

বেকারত্ব হ্রাস: দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব হ্রাসে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। দক্ষ জনবল তৈরি করে এই শিক্ষা বেকারত্বের হার কমাতে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।

উদ্যোক্তা তৈরি: কারিগরি শিক্ষা শুধু চাকরির জন্যই নয়, স্ব-কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যও দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করে। একজন কারিগরি শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের দক্ষতা ব্যবহার করে ছোট বা মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, যা অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থান তৈরি করে। যেমন, একজন ইলেকট্রিক্যাল বা কম্পিউটার টেকনোলজির ডিপ্লোমাধারী নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারেন।

জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা: শিল্প, কৃষি, সেবা খাত সহ দেশের অর্থনীতির সকল স্তরে দক্ষ জনবলের চাহিদা রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা এই চাহিদা পূরণে সরাসরি অবদান রাখছে, যা সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন: বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক কারিগরি দক্ষ জনবল বিদেশে কর্মরত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে। বিদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেশি হওয়ায় কারিগরি শিক্ষা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

"একটাই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ" – এই মন্ত্রকে সামনে রেখে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দিতে হবে, কারণ এটিই আজকের বিশ্বের চাহিদা। সফট স্কিলস এবং হার্ড স্কিলস উভয়ের উন্নয়নই ব্যক্তি জীবন ও কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। বিশেষত উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থাকলে এই দক্ষতাগুলো আত্মবিশ্বাস, উদ্ভাবন এবং টিকে থাকার শক্তি যোগায়।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এই লক্ষ্য পূরণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাদের প্রণীত যুগোপযোগী কারিকুলাম, মানসম্মত পরীক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিল্প খাতের সাথে নিবিড় সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ তরুণকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করছে। তবে, এই ধারাকে আরও গতিশীল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দক্ষতা উন্নয়নকে জাতীয় অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং কারিগরি শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে দক্ষতাকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে দেখা হবে, তখনই আমরা একটি সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব।

লেখক:

ফাউন্ডার কিনলে ডট কম 
ফাউন্ডিং মেম্বার অফ ই-ক্যাব -৩৩
মোবাইল: ০১৭১৩০১৭৪২৮
ই-মেইল: [email protected]

শেয়ার করুনঃ
Advertisement