‘আমি রায়হান, মাথার খুলি উড়ায় ফেলব’

‘আমি রায়হান, মাথার খুলি উড়ায় ফেলব’

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

Published : ১৫:২০, ৮ আগস্ট ২০২৫

চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট এলাকায় একটি ওষুধের দোকানিকে মুঠোফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ফের আলোচনায় এসেছেন ‘সন্ত্রাসী’ মোহাম্মদ রায়হান। পুলিশের ভাষ্য মতে, রায়হান চট্টগ্রামের কারাগারে থাকা কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদের অনুসারী। এই চক্রের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে, যা গত এক দশকে নগরের বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

গত ২৫ জুলাই রাতে কালুরঘাটের ওষুধ ব্যবসায়ী মো. রিদুয়ানকে ফোনে হুমকি দেন রায়হান। ফোনালাপের দৈর্ঘ্য ছিল ৫ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড। রায়হান ফোনের শুরুতেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে দোকানিকে বলেন, তিনি ঢাকাইয়া আকবর খুনের মামলার দুই নম্বর আসামি এবং প্রয়োজনে তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে দেবেন। তিনি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, দোকানির মাধ্যমে তাঁর অনুসারীরা মারধরের শিকার হয়েছেন। ব্যবসায়ী দাবি করেন, তাঁর সঙ্গে এক ক্রেতার ঝগড়ার সময় বাইরে থেকে লোকজন এসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে। তবে তিনি কারও পরিচয় জানেন না এবং হুমকির ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেননি। তবে পুলিশ বিষয়টি অবগত আছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তথ্য মতে, রায়হানের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলা। এসব মামলার বেশিরভাগই ২০২3 সালের ৫ আগস্টের পর দায়ের করা হয়েছে। এ সময় থেকে রায়হান চট্টগ্রাম নগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড, গুলিবর্ষণ এবং চাঁদাবাজিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

২০২4 সালের ১৩ জুলাই রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের ইশান ভট্টের হাটে যুবদল নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে বোরকা পরে এসে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং রায়হানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠে। এর আগে, গত ২৩ মে নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে ঢাকাইয়া আকবরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে আকবর হাসপাতালের বেডে রায়হানকে গুলি করার জন্য দায়ী করেন।

পুলিশ জানায়, রায়হান ও ছোট সাজ্জাদের মধ্যে পরিচয় ঘটে হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় কারাবাসের সময়। জামিনে বের হওয়ার পর তাঁরা একসঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। বড় সাজ্জাদ বর্তমানে বিদেশে পলাতক থাকলেও তাঁর হয়ে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে ছোট সাজ্জাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। রায়হান এখন সেই বাহিনীর অন্যতম সক্রিয় সদস্য এবং অস্ত্রভাণ্ডারের দেখভালের দায়িত্বে আছেন বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সর্বশেষ গত শুক্রবার চান্দগাঁও থানার মোহরায় নদী থেকে বালু তোলার খননযন্ত্র ব্যবসায়ী মো. ইউনুসকে গুলি করার পেছনেও রায়হান ও সাজ্জাদ বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় আহত ব্যবসায়ী বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

চট্টগ্রাম নগরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অন্যতম মূর্তপ্রতীক হয়ে উঠেছেন বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী। তিনি ২০০০ সালের বহুল আলোচিত আট ছাত্রলীগ নেতা খুনের মামলার আসামি ছিলেন। ওই মামলায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পেলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান। তিনি জামায়াতে ইসলামী–সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ ১৭টি মামলা রয়েছে।

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বলেন, ‘কালুরঘাটে ব্যবসায়ীকে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া ব্যক্তি সন্ত্রাসী রায়হান। তাঁকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মোহরায় ব্যবসায়ীকে গুলি করার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরাও সাজ্জাদ ও রায়হানের লোক।’

পলাতক থাকা রায়হানের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার তাঁর মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরে একের পর এক খুন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এই সংঘবদ্ধ চক্রের দাপট স্পষ্টভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র পুলিশি অভিযানে এই চক্র নির্মূল সম্ভব নয়; প্রয়োজন বিচারিক প্রক্রিয়ার দ্রুততা, জামিন নীতির সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আইন প্রয়োগ।

শেয়ার করুনঃ
Advertisement