হুন্ডি কী? কেন অবৈধ

Published : ১৫:২৯, ২ নভেম্বর ২০২৪
প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের অন্যতম একটি উপায় হলো হুন্ডি। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়।
বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয় না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হুন্ডির ইতিহাস
মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিলো অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সাথে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি।
ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকতো তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে।মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।
১৭৫৭ সালের পলাশী ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারত জুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানীর সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।
তবে ওপরে যেমন বলা হয়েছে আমাদের দেশে যেহেতু হুন্ডি ব্যবসা ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন নিষিদ্ধ, তাই আমাদের দেশের নাগরিকদের কর্তব্য দেশের আইন অনুসরণ করে হুন্ডি ব্যবসা বা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন না করা।
হুন্ডি কেন অবৈধ
হুন্ডি ব্যবসার কার্যপ্রণালি বেশ সরল। একজন প্রবাসী শ্রমিক তাঁর আয়ের কিছু অংশ দেশে পাঠাতে চাইলে, তিনি একজন হুন্ডি এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করেন। এজেন্ট প্রবাসীর কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে এবং দেশের অভ্যন্তরে একজন স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে অর্থ পৌঁছে দেন। এ প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাংক বা বৈধ অর্থ লেনদেন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যম ব্যবহার করা হয় না, ফলে এই অর্থ লেনদেনের কোনো সরকারি নথি থাকে না। এই টাকার কোনো আইনগত ভিত্তি না থাকাতে ট্যাক্স ফাইলে এই টাকা উল্লেখ করা যায় না। ফলে কঠোর পরিশ্রম করে উপার্জিত টাকা কালো টাকায় পরিণত হয়।
হুন্ডি ব্যবসা অবৈধ এবং এর মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এর ফলে অর্থ লেনদেনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে এবং অর্থনৈতিক অপরাধের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এছাড়া, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপের জন্যও হুন্ডি ব্যবহার হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনে হুন্ডি একটি অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো বাংলাদেশি নাগরিক হুন্ডির সাথে জড়িত থাকলে তিনি তার কাজের জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে পারেন। হুন্ডিতে বা অবৈধ পথে দেশে টাকা প্রেরণ করলে তা প্রমাণিত হলে মানি লন্ডারিং আইনে অর্থ জরিমানা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও সশ্রম কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি হতে পারে। যেহেতু এটা অবৈধ একটি মাধ্যম তাই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো রসিদ প্রদান করে না। ফলে টাকা আত্মসাৎ কিংবা যাত্রাপথে হারিয়ে গেলে আইনের কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না। ফলে আপনার কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এটা খুবই অনিশ্চয়তাপূর্ণ একটি মাধ্যম। আাপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় করা কষ্টার্জিত টাকা অবৈধ আয় বা কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত হয়, যার আয়ের উৎস আপনি দিতে পারবেন না। আপনার ট্যাক্স ফাইলে এই টাকা উল্লেখ করতে পারবেন না। অন্য দেশের আইনেও হুন্ডি বা অবৈধ লেনদেনে জড়িত থাকলে জেল জরিমানাসহ স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো যেমন অনৈতিক, ঝুঁকিপুর্ণ ও অবৈধ তেমনি দেশের স্বার্থ পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দেশের প্রতি যার ন্যুনতম দেশপ্রেম আছে তার উচিত না হুন্ডি ব্যবহার করা। হুন্ডি ব্যবসা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং এতে সরকার কোনো রাজস্ব পায় না। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবৈধ অর্থ লেনদেনের কারণে অপরাধমূলক কার্যক্রমের প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। যেমন মাদকপাচার, মানবপাচার ইত্যাদি। হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বৃদ্ধি পায়। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থ লেনদেন হওয়ায় দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি হয়। হুন্ডি ব্যবসায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে অর্থনৈতিক নীতি এবং বিধি-বিধানের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয় না।
বিডি/এন