বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সালমান শাহ এমন এক নাম, যিনি অল্প বয়সেই কোটি ভক্তের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে গেছেন।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে তার মৃত্যু গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটনের নিজ বাসায় সালমান শাহকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
প্রথমে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বা ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, প্রায় তিন দশক পর মামলাটি নতুন মোড় নিয়েছে—এখন এটি হত্যা মামলা হিসেবে পুনরায় তদন্তের আওতায় এসেছে।
এ মামলায় মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান আসামি সালমান শাহর সাবেক স্ত্রী সামিরা হক, আর অন্য আসামিদের তালিকায় আছেন চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ আরও অনেকে।
কিন্তু অনেকের মনে প্রশ্ন—কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই? নামের শেষে ‘ভাই’ থাকায় অনেকেই ধরে নেন তিনি হয়তো চলচ্চিত্র জগতের কোনো গডফাদার বা আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘ভাই’ শব্দটি তার পারিবারিক পদবী। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পিতার নাম মোহাম্মদ ভাই এবং মাতার নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই। এমনকি পরিবারের নারীরাও নামের সঙ্গে ‘ভাই’ পদবী ব্যবহার করেন।
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পূর্বপুরুষের শিকড় ভারতের গুজরাটে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তারা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন। তাদের পরিবার পারস্য বংশোদ্ভূত বাহাইয়ান সম্প্রদায়ের অনুসারী। সময়ের ব্যবধানে ‘বাহাই’ শব্দটি স্থানীয় উচ্চারণে ‘ভাই’ হয়ে যায়।
এই পরিবারের আর্থিক অবস্থা শুরু থেকেই বেশ শক্তিশালী ছিল। পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে তারা ব্যবসার জগতে প্রতিষ্ঠা পান। আজিজ মোহাম্মদ ভাই ১৯৬২ সালে আরমানিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ধীরে ধীরে নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে ঢাকাসহ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার ব্যবসা মূলত হোটেল, রিসোর্ট ও আমদানি-রপ্তানি খাতের সঙ্গে যুক্ত। তবে বিভিন্ন সময়ে তার মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও উঠে এসেছে।
৯০–এর দশকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এমবি ফিল্মস নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার ব্যানারে প্রায় ৫০টির মতো জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এছাড়া বিজ্ঞাপন শিল্পেও তিনি নতুন গ্ল্যামারের ছোঁয়া এনে দেন।
তবে ব্যবসা ও চলচ্চিত্রের বাইরেও তিনি নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন। এরশাদের শাসনামলে তিনি একবার গ্রেপ্তার হন। চলচ্চিত্র জগতের অনেক নায়িকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও তার বিরুদ্ধে গুঞ্জন ছিল।
১৯৯৭ সালে সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। বিভিন্ন সূত্র দাবি করে, মৃত্যুর আগের এক পার্টিতে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক নাকি আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে চুম্বন করেছিলেন।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সালমান শাহ আজিজকে চড় মারেন। অনেকে এই ঘটনাকেই পরবর্তীতে হত্যার ‘মূল মোটিভ’ বলে উল্লেখ করেন।
এর কিছুদিন পর চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায়ও তার পরিবারের নাম আসে।
বর্তমানে আজিজ মোহাম্মদ ভাই থাইল্যান্ডে সপরিবারে বসবাস করছেন, সেখান থেকেই তিনি তার ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার স্ত্রী নওরিন মোহাম্মদ ভাই মাঝে মাঝে বাংলাদেশে এসে ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করেন।
চলচ্চিত্র, বিতর্ক, বিলাসিতা আর রহস্যময় অতীত—সব মিলিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এখনো বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত এক নাম।































