আজ বাঙালি জাতির নবান্ন উৎসব নবান্ন শুধু প্রাণের উৎসবই নয়,পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করার উৎসর্গ প্রথা

আজ বাঙালি জাতির নবান্ন উৎসব  নবান্ন শুধু প্রাণের উৎসবই নয়,পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করার উৎসর্গ প্রথা ছবি: সংগৃহীত

বিজনেস ডেইলি ডেস্ক

Published : ১৬:০০, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

আজ ১৬ নভেম্বর ও ১ অগ্রহায়ণ রবিবার বাঙালি জাতির নবান্ন উৎসব। ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন উৎসবে মেতে উঠার আনন্দঘন দিন ১লা অগ্রহায়ণ। নতুন ধানে হবে নবান্ন।

শহুরে প্রলোভন আর কর্পোরেট সংস্কৃতির চোরাবালিতে পা দিয়ে আটকে পড়া বিভ্রান্ত প্রজন্মকে শেকড়ের সংস্কৃতির সন্ধান দেবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব।

একেবারে অনাদিকাল ধরে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। একই রীতি মেনে দেশজুড়ে হবে নবান্ন উৎসব। গ্রামের মতো নগরেও থাকবে বর্ণাঢ্য আয়োজন। দিনব্যাপী আয়োজনে লোকায়ত জীবন ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জয়গান করা হবে।

সেইসঙ্গে আহ্বান জানানো হবে উৎপাদন বাড়ানোর। অবশ্য তারও আগে শুরু হয়ে গিয়েছিল ফসলের ঋতু হেমন্ত। কার্তিকের প্রথম দিন নতুন ঋতুকে স্বাগত জানানো হয়। এক সময় মরা কার্তিকে এসে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে যেত। অভাব দেখা দিত খাবারের।

সবাই তখন তাকিয়ে থাকত অগ্রহায়ণের দিকে। তবে যতদিন গেছে ততই বদলে গেছে হিসাব-নিকাশ। কার্তিক আর আগের মতো মরা কার্তিক নেই। এ মাসে ঘরে আসছে  বিপুল পরিমাণ ধান। বস্তুত শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও ভালো। কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ।

পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন কৃষক। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানী। ধান মাড়াই ও শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে মূল অপেক্ষা ছিল অগ্রহায়ণের।

লোক কবির ভাষায়-আইলো অঘ্রাণ খুশীতে নাচে প্রাণ/চাষি কাচিতে দিলো শান/কাচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষি পাকা ধান...। অগ্রহায়ণ মানেই আমন ধান কাটার মাস। কথায় বলে ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’ আর এই তেরো পার্বণের অন্যতম একটি পার্বণ ‘নবান্ন উৎসব’।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক ঋতুকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান হয় নবান্ন। যা প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন' পালিত হয়। অগ্রহায়ণ মাস এলেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে বেজে ওঠে এই উৎসবের পদধ্বনি। 'নবান্ন' শব্দের অর্থ হল 'নতুন অন্ন’।

গ্রাম বাংলায় হেমন্ত ঋতুতে যখন পাকা ধানের সোনালী আভা মাঠের চতুর্দিক মুখরিত করে তোলে, ঠিক সেই সময় নতুন আমন ধানে গোলা ভর্তি হয় কৃষকের। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ভরে ওঠে নতুন চালের গন্ধে। প্রধানত, নতুন ধান কাটা আর নতুন ধানের অন্ন রান্নাই হলো নবান্ন আর সেই খাবার পরিবেশনকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব।

নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা এবং বিভিন্ন প্রাণিকে উৎসর্গ করে আত্মীয়-স্বজনকে সেই খাবার পরিবেশন করা হয়। কখনো কখনো এই অনুষ্ঠানে বাড়ির জামাই ও মেয়েকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠিত কৃষিজ ফসল কাটার এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লৌকিক প্রথা দেখতে পাওয়া যায়।

সৃষ্টি হয় এক নতুন আবহের। নতুন ধান কেটে ঘরে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সমস্ত কৃষক পরিবারের লোকেরা। নতুন ধান কাটার পর গ্রাম বাংলার প্রচলিত গানে ঢেঁকির তালে সেই ধান ভাঙ্গার ঢুক্কুর ঢেক্কর শব্দ। তারপর সেই নতুন ধানের চালের গুঁড়ো সাথে বিভিন্ন রকম শীতকালীন ফল, দুধ,নতুন গুড় এবং সামান্য পরিমাণ আদা মিশিয়ে তৈরি করা হয় এক রকম নৈবেদ্য।

যা প্রথমে গৃহে অধিষ্ঠিত লক্ষী নারায়নের সামনে ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয় এবং পরবর্তীতে সেই নৈবেদ্য 'কাকের' সামনে দেওয়া হয়। যা কাকের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যায় পূর্ব পুরুষদের কাছে। লোকাচার অনুযায়ী এই প্রথাকে বলা হয় ‘কাকবলী’। এর সঙ্গেই বাড়ির আঙিনায় আলপনা দেওয়া হয়। এছাড়াও গৃহে আগত অতিথিদের জন্য নতুন চালের ভাত, পঞ্চব্যঞ্জন, নতুন চালের পিঠে, পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি রান্না করে পরিবেশন করা হয়।

হাজার হাজার বছরের পুরনো এই নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় বিষয় হল অসাম্প্রদায়িকতা। ঐতিহ্যবাহী চিরাচরিত এই গ্রামীণ উৎসব মাটির সাথে কৃষকের মেলবন্ধনের এক অনন্য রূপ। তাই তো কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বলেছেন ‘....হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’

নবান্ন উৎসবকে ঘিরে প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জের কিছু গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়। যেখানে মনোরঞ্জনের বিষয় হিসেবে সবার প্রথমে থাকে আঞ্চলিক কিছু নাচ গান। এছাড়াও গ্রামের বিভিন্ন হস্তশিল্প এবং নতুন ধান দিয়ে তৈরি সুস্বাদু পিঠেপুলি,পায়ের সমস্ত কিছুই গ্রামীণ মেলায় বিক্রি করতে দেখা যায়। নবান্ন উৎসবের মেলা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে।

গ্রামীণ মেলায় শুধু নবীনরা নয়,সর্বত্র ভাবে প্রবীণরাও অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও মেলার এক প্রান্তে বসে গানের পসরা, যেখানে অঞ্চলভেদে জারি-সারি,মুর্শিদি, লালন এবং বিচার গান পরিবেশিত হয়। ছোটদের জন্য এই মেলায় থাকে সার্কাস,পুতুল নাচ,নাগরদোলা এবং বায়োস্কোপের ব্যবস্থা।

প্রধানত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে শস্য উৎসব পালন করা হয়। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের 'নবান্ন উৎসবের' আনুষ্ঠানিক শুভ সূচনা করা হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে গড়ে ওঠা নবান্ন উৎসব বর্তমান যুগে কিছুটা হারিয়েছে তার জৌলুস। শিল্প ও নগরায়নের করাঘাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এই উৎসবের মূলভিত্তি।

সর্বস্তরের সর্ব সাধারণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠলে এবং আগ্রহী হলেই স্থায়িত্ব ঘটবে নবান্ন উৎসবের মতো বেশ কিছু ‘গ্রাম বাংলার পুরাতন ঐতিহ্য সমন্বিত উৎসবগুলির’। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ,বীরভূম, বর্ধমান এবং অগ্রদ্বীপের দোঁয়াশী গ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়। হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে করে অগ্রদ্বীপ স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো বা টোটো করে ১০ মিনিটের পথ গেলেই এই দোঁয়াশী গ্রামের নবান্ন মেলা দেখতে পাওয়া যায়।

নবান্নের উপর বিজন ভট্টাচার্যের লেখা একটি বিখ্যাত নাটক রয়েছে যেটিতে ১৯৪৩ সালের মহান বাংলার দুর্ভিক্ষের দুঃখজনক ঘটনাকে চিত্রিত করা হয়েছে। নবান্ন উৎসব উদযাপন পরিষদ (জাতীয় ফসল উৎসব কমিটি) ১৯৯৮ সাল করা হয়।  শাহরিয়ার সালাম সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পরিকল্পনাকারী। দিনব্যাপী উৎসবে বিপুল সংখ্যক সাংস্কৃতিক কর্মী, সংগঠন এবং পারফর্ম করে।

মানুষ শুধু মেলা দেখতে আসে না। এছাড়াও, তারা অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যেমন 'পিঠে মেকিং' (বিভিন্ন ধরণের বাঙালি কেক তৈরি), আসন-অঙ্কন, সিনিয়র সিটিজেনদের হাঁটা প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। একটি ‘আর্ট-ক্যা¤প’ সৃজনশীল মনের মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। যেখানে বিভিন্ন জেলার শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। গ্রামীণ বাংলার কিছু দুর্লভ জিনিস ঢেঁকি, কৃষকের বাড়ি থেকে সরাসরি বিভিন্ন জাতের ধান প্রদর্শনী ময়দানে প্রদর্শিত হবে।

উৎসবের সময় পাটি-সাপ্তা, পায়েশ, সবজি পায়েশ', জিলিপিপি (জিলিপি নয়) এর মতো কিছু সুস্বাদু বাংলা খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। বাউল গান, ছৌ-নৃত্য,যাত্রা,তরজা. কবি-গান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলার কালজয়ী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সামনে তুলে ধরা হয়। শিল্পীরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের প্রতিভা ও দক্ষতা প্রদর্শন করতে আসেন। তাছাড়া, গ্রামীণ কারিগরদের তৈরি হস্তশিল্পের প্রদর্শনী-কাম-বিক্রয়' স্টল বসানো হয়।

এটি কোনো ধর্মীয় আচার, ব্রত কিংবা পূজা নয়, বরং রিচুয়াল বা লোকাচার বলা যেতে পারে। অঞ্চল কিংবা ধর্মভেদে এই লোকাচার পালনের আচার ভিন্ন। আবার তা পালনের সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অথবা তিথি-নক্ষত্রের যোগ নেই। তবে শস্যপ্রাপ্তির সংযোগ আছে। একসময় শস্যকেন্দ্রিক নানা রীতিনীতি প্রচলিত ছিল বাঙালি সমাজে।

কারণ ধানই ছিল এদেশে সমৃদ্ধির শেষ কথা। আকাশমণি, কপিলভোগ, কাজলা, কামিনী, কুসুমকলি, ঘৃতশাল, চন্দনচূড়া, চন্দ্রপুলি, চিনিসাগর, জটাশালী, জনকরাজ, জামাইভোগ, দাদখানি, দুধকমল, নীলকমল, পঙ্খিরাজ, পদ্মরাগ, হীরাশাল, মানিকশোভা, মুক্তাঝুরি এমন বিচিত্র আর বাহারি নামের রকমরি সব ধানে সমৃদ্ধ এই দেশে কার্তিক মাসের খাদ্যাভাব বাঙালিকে যতটা বিচলিত করত, অগ্রহায়ণের শস্যপ্রাপ্তি তাকে ঠিক ততটাই আনন্দ দিত।

আহারে-বিহারে সেই আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার উৎসবই নবান্ন। সাদা দুধ এখন শুভ্র চালে রূপ পেয়েছে। কুয়াশাভেজা মাঠ থেকে সবুজ থেকে সোনালি হয়ে ওঠা সেই পাকা ধান কেটে আনার তোড়জোড় চলছে গ্রামে গ্রামে। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে এই ধান মাড়াই-মলন শেষে নতুন চালের ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েসে জনপদ থেকে জনপদে হবে নবান্ন।

গ্রামবাংলার উৎসবের বর্ষপঞ্জির শুরুটা হয় নবান্ন দিয়েই। আর সমাপ্তি ঘটে চৈত্রসংক্রান্তির চড়কে। নবান্নকে মূলত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং আগামী বছরের জন্য সুফসল প্রাপ্তির কামনায় নিবেদিত উৎসব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন লোক সংস্কৃতি গবেষকরা। কথিত আছে, মোগল শাসনের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে বন্যায় আমন ধান নষ্ট হয়ে গেলে খাজনা আনাদায়ী থাকত।

খাজনা আদায় নিশ্চিত করতে পয়লা অগ্রহায়ণের বদলে পয়লা বৈশাখ থেকে খাজনা আদায় করার আইন করা হয়। এ ব্যাপারে প্রয়াত লেখক, লোক সংস্কৃতি ও পল্লী সাহিত্য গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান তার এক লেখায় বলেন, মোগল সম্রাটেরা সুবেদার মুর্শিদ কুলি খানের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে প্রচুর পরিমাণে কর আদায়ের নির্দেশ জারি করেন। কৃষিভিত্তিক বাংলায় মোগলদের আচরিত ‘হিজরি সন’ কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য ছিল প্রতিকূল।

কারণ, প্রতিবছর হিজরি সন সাড়ে ১০ বা ১১ দিন এগিয়ে আসে। এদিক বিবেচনায় রেখে মুর্শিদ কুলি খান আকবর প্রবর্তিত এলাহি সন'র আদলে বাংলায় হিজরি চান্দ্র ও ভারতীয় সূর্য-সনের সম্মিলনে বাংলা সন চালু করেন বলে মনে হয়। সম্ভবত পয়লা অগ্রহায়ণের বদলে এখন বাঙালির প্রধান উৎসব নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ।

সর্বপরিসরে অগ্রহায়ণের নবান্নের সেই জাঁকালো ভাব আর নেই। তবু গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রীতিতে পালিত এই শস্যোৎসব ইতিহাসের সেই ধারাকে অনেকখানি ধরে রেখেছে। লোকসংস্কার অনুযায়ী, হেমন্তের নতুন আমন ধান ঘরে এনে প্রথমে তা গৃহদেবতাকে নিবেদন করা হয়। যেহেতু দেবতার বরে ফসল ফলে, সে জন্য দেবতাকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস সব কৃষকই করে থাকেন।

সামাজিক প্রথা, রীতি ও কৃত্যের পরিক্রমায় কোন কোন জায়গায় মাঘ মাসেও নবান্ন উদ্যাপনের প্রথা রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উদয় শংকর বিশ্বাস বলেন, নাটোরের বাগাতিপাড়ার জামগ্রামের শাঁখারীরা নবান্নের দিন কোনো কাজ করেন না।

এদিন বাড়ির নারীরা নয় রকম ফল দিয়ে নয়টি কলাপাতায় নৈবেদ্য সাজিয়ে বাড়ির তুলসীতলা, রান্নাঘরের দরজায়, গোয়ালঘরের দরজা, উঠান ও ঠাকুর ঘরসহ নয় জায়গায় তা রেখে দেন। নয় রকম সবজি দিয়ে নয় ধরনের ব্যঞ্জন তৈরি করা হয় দুপুরে খাবারের জন্য। খাবারের তালিকায় থাকে নয় রকম শাক।

খান নয় ধরনের মিষ্টান্ন। আসলে তাদের কাছে নবান্ন নয়ের প্রতীক। আবার বগুড়ার নন্দীগ্রামের হিন্দু নারীরা নবান্নের দিন দিনের বেলায় কোনো আগুনের কাজ করেন না। নবান্নের দিন সূর্য ওঠার আগে কৃষক মাঠে গিয়ে ধানের জমিতে ফুল-তুলসী-চালকলা-ফল দিয়ে নৈবেদ্য প্রদান করেন।

বাড়িতে জমির ধানের গোছা কেটে নিয়ে এসে ঘরের দরজায় টাঙিয়ে দেন। এরপর বাড়ির সবার জন্য মাছ ক্রয় করতে যান। নবান্নের দিন বগুড়ার নন্দীগ্রাম-শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মাছের মেলা বসে। বরিশালের উজিরপুর-আগৈলঝাড়া উপজেলার হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজন নবান্নে নতুন ধানের চালের গুঁড়িতে বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে এক ধরনের শরবত তৈরি করেন।

সকালে প্রতিটি বাড়িতে নারায়ণপূজা করা হয়। নওগাঁর মান্দা-আত্রাই অঞ্চলে নবান্নের দিন বাড়ি পরিষ্কার করে নতুন ধানের চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি পিটুলির সাহায্যে বাড়ির উঠান ও ঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকা হয়। সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর পূজা করেন বাড়ির নারীরা।

এভাবে পুরো অগ্রহায়ণজুড়ে লক্ষ্মীর পূজা করা হয় অন্তত চারবার। আর বেশির ভাগ অঞ্চলে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় নতুন ফসলের পায়েস, ভাত, নানা ব্যঞ্জন প্রথমে কাক বা পাখিদের নিবেদন করার রীতি দেখা যায়। তাদের বিশ্বাস, এতে মৃত পূর্বপুরুষরা খুশি হন এবং পাখিদের মাধ্যমে সেই খাদ্য তাদের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়।

বাঙালি হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও নতুন চালের পায়েস রান্না মসজিদে শিরনি দেন। এছাড়া নবান্নের দিন লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান। উদয় শংকরের ভাষ্য, ‘বাঙালির প্রধানতম উৎসবটি বিক্ষিপ্তভাবে পালন করা হলেও এখন আর ঘটা করে সাড়ম্বরে নবান্ন পালনের রীতি খুব বেশি চোখে পড়ে না।

সনাতন হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো এই লোকাচারটি পালন করা হয় পুরোনো রীতি মেনে, কিন্তু বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজে নবান্ন এখন অনেকটাই ব্রাত্য’। তবে শহুরে জীবনেও বেশ কয়েক বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব পালন করা হচ্ছে।

জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এ কথা বলাই যায় যে, 'প্রচুর শস্যের গন্ধ' এবং ‘পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে’ নবান্নকে কেবল পঞ্জিকার পাতায় আটকে রাখা যাচ্ছে না। 

বিডি/এএন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement