রংপুরে মামলাজটে পড়েছে বিচারপ্রত্যাশীরা

Published : ১৭:৫৩, ৪ অক্টোবর ২০২৫
রংপুরে বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন হাজার হাজার বিচারপ্রত্যাশী। মামলাজটের পড়েছে তারা। কেউ কেউ সহায় সম্বল বিক্রি করে মাসের পর মাস আদালতে আসছেন, কিন্তু কাঙি্ক্ষত বিচার পাচ্ছেন না।
বিচারক স্বল্পতা, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় জেলার আদালতগুলোতে মামলাজট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রংপুর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ২৪ হাজারের বেশি মামলা। বিচারক স্বল্পতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে মামলার জট। সংশ্লিষ্টরা বলেন, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে নতুন বিচারক নিয়োগ, অন্যান্য জনবল বৃদ্ধি, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যথায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে থাকবেন সাধারণ মানুষ, প্রশ্নবিদ্ধ হবে বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা। জানা যায়, রংপুর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আওতাধীন আমলি আদালত ও বিচার আদালতে মাদক মামলা, নারী ও শিশু মামলা, এনআই অ্যাক্ট মামলা, যৌতুক নিরোধ মামলা, শ্রম মামলা, মোটরযান মামলা, সড়ক পরিবহন মামলা, ফৌজদারি বিধি মামলা, দ্রুত বিচার মামলাসহ বিভিন্ন মামলার বিচারকার্য চলমান রয়েছে।
এর মধ্যে ২০২৪ সালে আমলি আদালত ও বিচার আদালতে মোট মামলা ছিল ৫২ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ হাজার ৯৯২টি, অন্য আদালতে বদলি হয়েছে ১৬ হাজার ৩৪১টি, বিচারাধীন রয়েছে ২৩ হাজার ৬৯২টি, পাঁচ বছরেরও অধিক সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৭৮৯টি এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলা স্থগিত রয়েছে দুটি। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আমলি আদালত ও বিচার আদালতে মোট মামলা ছিল ৩০ হাজার ৯০৪টি।
তিন মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৮০৫টি, অন্য আদালতে বদলি হয়েছে ৪ হাজার ১৭৫টি, বিচারাধীন ২৩ হাজার ৯৪৩টি, পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন ৯০২টি এবং ৪টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বারান্দায় কথা হয় বিচারপ্রার্থী এক নারীর সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২৪ বছর ধরে এই কোর্টে আসি আর যাই। আজ হবে, কাল হবে, নয়তো পরশু হবে এই আশায়।
কখনো লম্বা লম্বা তারিখ দেয়। এভাবে বছরের পর বছর শুধু হয়রানির শিকার হচ্ছি। কোর্টের দরজায় আসছি আর যাচ্ছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। রায় হবে হবে করেও হয় না। কোনো সুফল পাচ্ছি না। রংপুর জেলা পুলিশের কোর্ট পরিদর্শকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে রংপুরের আট উপজেলার ৮টি থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে ৬৮৬টি।
এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ১৮১ জনকে। ২০২৪ সালে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ৫৩৯টি মামলা করা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ১৩৬ জনকে। জেলা পুলিশের কোর্ট পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে থানা পুলিশ যেসব মামলা করেছে, সেগুলো বিচারাধীন। পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার, চার্জশিট প্রদানসহ আইনি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করেন, মামলা বিলম্বিত হলে সুযোগ পায় আসামিরা। এ কারণে এমন মামলা গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা চলে আসে। এ কারণে নতুন আইনে এসব মামলা নিষ্পত্তি হলে ভালো হতো।
সরকারি কেঁৗসুলি আফতাব হোসেন বলেন, রাষ্ট্র বাদী হয়েছে এমন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে মামলার সমন জারি, চার্জশিট দেওয়া, সাক্ষ্য—প্রমাণ আদালতে উপস্থাপনসহ কিছু কিছু মামলার রায় পর্যায়ে যেতে তিন—চার বছর সময় লেগে যায়। রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল—২—এর বিশেষ পিপি মোকসেদুল হক বলেন, আমি কয়েক মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। ট্রাইব্যুনাল—২—এ ২০০৩ সালের বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। বিচারক সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে।
সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল—১—এর বিশেষ পিপি সফি কামাল বলেন, তিনটি ট্রাইব্যুনালে পাঁচ হাজারের মতো মামলা রয়েছে। আমরা সেগুলোর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। তবে এটা সত্য, ১৮ থেকে ২০ বছরের পুরোনো অনেকগুলো মামলা বিচারাধীন। সেগুলোও নিষ্পত্তির চেষ্টা করছেন বিচারক।
রংপুরের সিনিয়র আইনজীবী ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ রইছ উদ্দিন বাদশা বলেন, মূলত তিন কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাগুলোর বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। প্রথমত তদন্তের নামে বছরের পর বছর পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তার কালক্ষেপণ, দফায় দফায় আদালতে আবেদন করে সময় নেওয়া এবং তৃতীয়ত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পুলিশের অনীহা। এসব কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাদী ও আসামি দুই পক্ষই। মানবাধিকার কর্মী ও রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আদালতে ঘুরে ঘুরে বিচারপ্রার্থীদের অনেকে নিঃস্ব হয়েছে। সেই মানুষগুলোর কথা ভাবতে হবে। আদালতে প্রতিমাসে বিচারপ্রার্থীরা আসে, হাজিরা দেন আর বাড়িতে চলে যান। আমাদের কাছে অভিযোগ করে, বলে কবে ন্যায়বিচার পাব? এর জবাব আমরা দিতে পারি না।
সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জোবাইদুল ইসলাম বুলেট বলেন, বিচারপ্রার্থীরা আদালতপাড়ায় বছরের পর বছর ঘুরে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে বিচারকের স্বল্পতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদালত নির্দেশিত সময়ের মধ্যে মামলার সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে মামলার সংখ্যাও কমে যাবে, বিচারপ্রার্থীদেরও হয়রানি হতে হবে না।
বিডি/এএন