বিশ্বব্যাংকের মূল্যস্ফীতি ‘লাল তালিকায়’ বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাংকের মূল্যস্ফীতি ‘লাল তালিকায়’ বাংলাদেশ

বিজনেস ডেইলি ডেস্ক

Published : ১২:৩৮, ১৪ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশ টানা সোয়া চার বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতির ‘লাল তালিকায়’ অবস্থান করছে। ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রতিমাসে খাদ্যপণ্যের দাম গড়ে ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা থেকে দেশটি বের হতে পারেনি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুদ্রার অস্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক মন্দা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এই পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে।


বিশ্বব্যাংক প্রতি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার নির্ণয় করে তিন ধাপে ভাগ করে থাকে। যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম গড়ে ২ শতাংশের কম বাড়ে, তারা থাকে সবুজ তালিকায়—ঝুঁকিমুক্ত ধাপ। ২% থেকে ৫% বৃদ্ধিতে দেশটি যায় হলুদ তালিকায়—যা সতর্কবার্তা ধাপ। আর ৫% থেকে ৩০% বৃদ্ধিতে দেশটি পড়ে লাল তালিকায়, যা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নির্দেশ করে। ৩০% এর বেশি হলে দেশটিকে ‘পিঙ্গল তালিকায়’ রাখা হয়—যা সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধাপ।


বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০২১ সালের মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪.৮৭ শতাংশে নেমেছিল। এরপর থেকে তা কখনোই ৫ শতাংশের নিচে নামেনি। আলোচ্য সময়ে চাল, সবজি, ডিম, মুরগি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম ৫% থেকে ১৪% পর্যন্ত বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১৪.১০%—যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের সমান।

বাংলাদেশ অতীতে একাধিকবার সবুজ ও হলুদ তালিকায়ও ছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাত্র ০.২৫% বৃদ্ধিতে সবুজ তালিকায় এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ২.৫৭% বৃদ্ধিতে হলুদ তালিকায় ছিল দেশটি। তবে বেশিরভাগ সময়ই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫% এর ওপরে থাকায় লাল তালিকায় থাকতে হয়েছে।


করোনার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ায় খাদ্যপণ্যের দাম বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। বাংলাদেশে পরিস্থিতি আরও জটিল হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ডলারের দামের অস্থিরতাও মূল্যস্ফীতিকে উঁচুতে ধরে রাখে।

বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী, লাল বা পিঙ্গল তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মুদ্রার মান অস্থিতিশীল থাকে, বিদেশি বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয় এবং বৈদেশিক ঋণ ও বাণিজ্যে বাড়তি কমিশন ও গ্যারান্টি ফি গুনতে হয়। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়।


২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার টাকা ছাপানো বন্ধ, ডলারের দাম স্থিতিশীলকরণ এবং নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। ফলে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৭.৫৬ শতাংশে। তবে এটি এখনও লাল তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ৫ শতাংশের নিচে নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান প্রবণতায় সহসা লাল তালিকা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।


বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি। নীতি-নির্ধারকদের মতে, আমদানি নির্ভরতা কমানো, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাজার মনিটরিং জোরদার করতে না পারলে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, ধারাবাহিক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে টেকসইভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।

শেয়ার করুনঃ
Advertisement