রংপুর অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী জাতের মাছ

রংপুর অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী জাতের মাছ

রংপুর প্রতিনিধি:

Published : ১৭:৪৪, ৩ মে ২০২৫

বাংলাদেশ নদীমার্তৃক দেশ। অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের দেশে। নদী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট নদীর সংখ্যা ১০০৮। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রবহমান নদী রয়েছে ৯৩১টি। নাব্যতা হারিয়েছে এমন নদীর সংখ্যা ৩০৮। নাব্যতা হারানো নদীর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৫টি, রংপুর বিভাগে ৭১টি, রাজশাহী বিভাগে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি, সিলেট বিভাগে ১০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি এবং খুলনা বিভাগে ৮৭টি। কিন্তু কালের বিবর্তনে কমছে নদী, খাল, বিলসহ বিভিন্ন ধরনের জলাশয়। যেসব নদী, খাল বা বিল রয়েছে, তা আবার বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে। 

ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় এদেশের খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ও নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশি মাছে। 

ওই সময়ে চাহিদার তুলনায় মাছ বেশি আমদানি হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ নদীপারের হাট-বাজারগুলোতে দেশি মাছ কেনার জন্য বছরজুড়েই ভিড় করত। চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

রংপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি ভাওয়াইয়া গান ‘নয়া ডাঙ্গাতে মাছ উজাইছে হ্যাঙ্গা পাতায়া থইস’। প্রায় ৫০ বছর আগে গানটি রচিত হয়েছে।

মূলত ১০৮ প্রকার দেশি জাতের মাছ নিয়ে এই গান লেখা হয়েছিল। কিন্তু গানটি থাকলেও ১০৮ প্রকারের মাছ আর মিলছে না। 

মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০ বছর আগে রংপুর অঞ্চলে ১০৮ জাতের মাছ পাওয়া যেত। তবে বর্তমানে ৩০-৩৫ জাতের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আর ৭৩-৭৮ জাতের মাছ ২০ বছরে হারিয়ে গেছে। 

লালমনিরহাট জেলা মৎস্য স¤প্রসারণ কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, বর্তমানে যে ৩০-৩৫ জাতের দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তার পরিমাণ অনেক কম। তুলনা করা হলে আগের চেয়ে মাত্র ১২-১৫ শতাংশ দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অধিকাংশ জলাশয় পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মাছের বিচরণ ও বৃদ্ধি থেমে যাচ্ছে। 

এছাড়া কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় দূষিত হচ্ছে জলাশয়ের পানি। এতে দেশি মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া চায়না দুয়ারি জাল, মরণ জাল, কারেন্ট জাল ও রিং জাল দিয়ে মাছ শিকার করায় মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন হচ্ছে। মাছের বিড্রিং গ্রাউন্ডগুলো নষ্ট করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। 

কৃষকদের দেশি জাতের মাছচাষ করার পরামর্শ হচ্ছে। কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। হাইব্রিড মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা সেদিকে ঝুঁকছেন। তিনি মৎস্য কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এখন যেসব দেশি জাতের মাছ দেখা যাচ্ছে, এক যুগ পরে এগুলোও হয়তো দেখা যাবে না। 

লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলার কৃষি উদ্যোক্তা আমিনুল হক বলেন, তাদের গ্রামের বিলে ৩ একর আয়তনের একটি পুকুর আছে। কয়েকবছর আগে সেখানে সারাবছরই পানি থাকত। কিন্তু এখন বছরের অধিকাংশ সময় তা পানিশূন্য থাকছে। এতে পুকুরটিও শুকিয়ে যায়। 

এই বিলে আগে গ্রামের মানুষ সারা বছর দেশি মাছ পেতেন। এখন অনেক দেশি মাছ এখন দেখা যায় না। আগে পুকুর শুকিয়ে ৩৫-৪০ মণ দেশি মাছ ধরতাম। আর এখন পাচ্ছি ৩-৪ মণ। 

জেলেরা বলেন, জলাশয় বিলীন হওয়া ও দ্রুত বর্ধনশীল হাইব্রিড মাছের চাষ বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে স্থানীয় জাতের মাছ বিলুপ্তির পথে। 

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সিংগারডাবরি গ্রামের যতীন চন্দ্র দাস বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও স্থানীয়রা অনেক দেশি জাতের মাছ পেতেন। কিন্তু এখন সেগুলো বিরল হয়ে উঠছে। এখন স্থানীয় মাছ ৬০০-১৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মাত্র ৫ বছর আগেও ২০০-৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হত। দেশি জাতের মাছ ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। 

লালমনিরহাট শহরের বানিয়াপট্টি এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুশান্ত সরকার বলেন, প্রায় ৩ মাস ধরে খোঁজাখুঁজির পর ৫৫০০ টাকায় তিন কেজি চিতল মাছ ক্রয় করেছেন। লালমনিরহাট শহরের গোশালা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী শ্যামল চন্দ্র রায় বলেন, দেশীয় জাতের মাছের জন্য মানুষ অগ্রিম টাকা দেন। তবে বাজারে চাহিদার মাত্র ৪-৫ শতাংশ দেশি জাতের মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা পাড়ের নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, বর্তমানে বেশিরভাগ সরকারি মালিকানাধীন জলাশয় ইজারাদারদের কাছে লিজ দেওয়া হচ্ছে। যারা এসব জলাশয় লিজ নিচ্ছেন তারা বেশি লাভের জন্য উন্নত জাতের মাছ চাষ করছেন। অন্যদিকে অনেক প্রাকৃতিক জলাশয় শুকিয়ে গেছে, ফলে দেশী মাছ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। 

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোব গ্রামের কৃষক ছাবেদ আলী বলেন, গ্রামে ৭ একর জমি জুড়ে ৫টি পুকুর রয়েছে। সেখানে তিনি দ্রুত বর্ধনশীল হাইব্রিড জাতের মাছ চাষ করেন এবং প্রতি বছর ভালো লাভ করেন। দেশী জাতের মাছ চাষ করা হয় না, কারণ মাছ বৃদ্ধিতে অনেক সময় লাগে। 

তাছাড়া, এখন আর সহজে দেশি জাতের মাছের পোনা খুঁজে পাওয়া যায় না। নদী নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি সংস্থা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন নদীর দূষণ নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ওই গবেষণায় বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা ভয়াবহ। সেখানে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ গড়ে ২.০ মিলিগ্রামের নিচে। অথচ মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণির জীবন ধারণের জন্য পানিতে

লিটারপ্রতি গ্রহণযোগ্য দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা হলো ৪.০০ মিলিগ্রাম। অপরদিকে রুই, কাতলা জাতের মাছের জন্য এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫-৭ মিলিগ্রাম। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, দেশের অধিকাংশ নদ-নদী এখন মারাত্মক দূষণের শিকার। ফলে বুড়িগঙ্গা এবং অন্য অনেক নদীতে মাছ ও অন্য জলজ প্রাণীর জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।এতে নদীগুলোর মাছ তথা জলজ প্রাণি ধীরে ধীরে শূন্য হতে শুরু করেছে। গবেষণায় ৫৬টি নদীর ১৯টি ছিল ঢাকা বিভাগের, যেগুলোর সবই মারাত্মক দূষণের
শিকার। 

এছাড়াও জরিপে খুলনার ৭টি, সিলেটের ৫টি, চট্টগ্রামের ৮টি, রাজশাহীর ২টি, বরিশালের ১১টি ও রংপুরের ৪টি নদীর দূষণমাত্রা দেখা হয়। এছাড়াও সমুদ্রের পানিতে অম্লতা বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ও অ্যাকুয়াকালচার অনেকটাই হুমকির সম্মুখীন। পানিতে এ অম্লতা বৃদ্ধি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। সরাসরি মাছের ওপর সামুদ্রিক পানিরঅম্লতা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল কাজ করে যাচ্ছে। 

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাপানের নাগাসাকি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক ইউনিভার্সিটি, নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অফ বারগেন এবং জার্মানির লাইবনিজ ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্স। সমুদ্রের পানির অম্লতা বৃদ্ধির এ অবস্থা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে তা হবে আরও মারাত্মক। 

বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর ফলে ২০৫০ সালের মধ্যেই পৃথিবী থেকে কোরাল রিফ হারিয়ে যেতে পারে। আর কোরাল রিফ যদি না থাকে, তাহলে এর ওপর নির্ভরশীল মাছের প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীর রিফ ফিশারিজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেটি মোট মৎস্য আহরণের প্রায় ৯-১২ শতাংশ। এতে পৃথিবীর প্রায় ৯৪টি দেশে কোরাল রিফের ওপর নির্ভরশীল পর্যটন শিল্পও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বিডি/ও

শেয়ার করুনঃ
Advertisement