আয়ারল্যান্ডের গলওয়ের তুয়াম শহরে সাবেক ‘সেন্ট মেরিজ মাদার অ্যান্ড বেবি হোম’-এর স্থানে গোপন গণকবরের খোঁজ মিলেছে। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এনেছেন শৌখিন ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলিস। ২০১৪ সালে তাঁর অনুসন্ধানে প্রথমবারের মতো প্রকাশ পায়, আশ্রমের ভেতরে একটি সুয়ারেজ ট্যাঙ্কের নিচে শুয়ে আছে শত শত শিশুর মরদেহ। কাল সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে এই জায়গায় আনুষ্ঠানিক খনন কাজ, যা প্রায় দুই বছর চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম চালানো এই চার্চ-পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে আশ্রয় পেতেন অবিবাহিত মায়েদের সন্তানরা। সন্তান জন্মের পর মায়েদের থেকে আলাদা করে ফেলা হতো নবজাতকদের। আশ্রমের মৃত্যুর রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায়, এখানে প্রথম মারা যায় পাঁচ মাস বয়সী প্যাট্রিক ডেরেইন, ১৯১৫ সালে। সর্বশেষ মৃত্যুর নথি ১৯৬০ সালে মেরি কার্টির।
তাদের মাঝে আরও ৭৯৪টি শিশুর মৃত্যুর নথি রয়েছে, যাদের অধিকাংশেরই কোনো কবর নেই, নেই নামফলক বা শিলালিপি। প্রাক্তন বাসিন্দা পিজে হাভারটি জানান, তিনি আশ্রমে কাটানো শৈশব আজও ভুলতে পারেননি। আশ্রমের শিশুদের ‘রাস্তার ময়লা’ হিসেবে আলাদা করে রাখা হতো। স্কুলে অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া হতো না, খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত রাখা হতো। শুরুতে অনুসন্ধান ছিল নিছক কৌতূহল। ক্যাথরিন করলিস একটি স্থানীয় ইতিহাস কোর্সে ভর্তি হন পারিবারিক ইতিহাস জানার উদ্দেশ্যে। পরে আগ্রহ জন্মায় তুয়ামের ‘হোম চিলড্রেন’দের ইতিহাস নিয়ে। স্থানীয় কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক তাঁকে সাবেক আশ্রমের জায়গায় নিয়ে যান। সেখানে এক মূর্তির নিচে ঘাসে ঢাকা জায়গায় একসময় দুটি শিশু একটি কংক্রিট স্ল্যাব সরিয়ে নিচে খোলা গর্তে হাড় দেখতে পেয়েছিল। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, এগুলো ১৮৪০-এর দশকের দুর্ভিক্ষে মৃতদের। কিন্তু মানচিত্র যাচাই ও রেকর্ড বিশ্লেষণে ক্যাথরিন নিশ্চিত হন, এই হাড়ের উৎস ভিন্ন। ১৯২৯ সালের মানচিত্রে এলাকাটি ছিল ‘সুয়ারেজ ট্যাঙ্ক’, যা ১৯৩৭ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের মানচিত্রে হাতের লেখা “কবরস্থান” শব্দটি দেখা যায়। এ থেকেই ধারণা মেলে, শিশুদের মরদেহ সুয়ারেজ ট্যাঙ্কেই ফেলে রাখা হয়েছিল। ২০১৪ সালে এটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। একই বছর সাক্ষ্য দেন মেরি মরিয়ার্টি নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি ১৯৭০-এর দশকে দুর্ঘটনাবশত সেই গর্তে পড়ে গিয়েছিলেন। গর্তে অসংখ্য ছোট কাপড়ে মোড়ানো বস্তু দেখতে পান তিনি, যেগুলো ছিল ছাদ পর্যন্ত ঠাসা। পরে তাঁর সন্তান জন্মের সময় হাসপাতালের সেবিকা একই ধরনের কাপড়ে মোড়ানো পুঁটলিতে নবজাতক তুলে দেন, তখনই মেরির ধারণা হয়—গর্তে যা দেখেছিলেন, তা শিশুদের মৃতদেহ। সত্য জানার প্রত্যাশায় আছেন আনা করিগানসহ অনেকেই। তিনি পরে জানতে পারেন, তাঁর মা তুয়ামে দুই সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন—জন এবং উইলিয়াম।
জনের মৃত্যুর সনদ মিললেও উইলিয়ামের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। এই ঘটনা আরও স্পষ্ট করে তোলে—শিশুদের শুধু মৃত্যু নয়, ছিল সম্পূর্ণ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও। ২০১৭ সালে সরকারের প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়, সেখানে রয়েছে ‘মানব দেহাবশেষের বড় উপস্থিতি’। এবার শুরু হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ খননকাজ। প্রধান সমন্বয়ক ড্যানিয়েল ম্যাকসুইনি জানিয়েছেন, শিশুদের হাড় এতটাই ক্ষুদ্র ও ভঙ্গুর যে তা শনাক্তকরণ অত্যন্ত কঠিন হবে। এতে সময় লাগবে প্রায় দুই বছর। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর হয়তো পরিবারগুলো তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের অন্তত জানাতে পারবে—তারা কোথায় এবং কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। অনেকে হয়তো তাদের ভাইবোন বা আত্মীয়ের অস্তিত্ব কখনোই জানতে পারেননি, এবার তারা সেই জবাবের অপেক্ষায়।