আট বছরেও রোহিঙ্গা গণহত্যার শেষ নেই

Published : ১১:৩৯, ২৭ আগস্ট ২০২৫
আট বছর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করেছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এই জাতিগোষ্ঠী নিজেদের জন্মভূমিতেই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়। সেনারা ‘পোড়ামাটি নীতি’ অবলম্বন করে প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করে। ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ দমনের নামে তথাকথিত নিরাপত্তা অভিযান চালিয়ে ৩০০-রও বেশি গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। তখন দেশটির ক্ষমতায় ছিল অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার। সুচি শুধু নীরব সমর্থনই দেননি, বরং বিশ্ববাসীর কাছে এই হত্যাযজ্ঞের সাফাইও গেয়েছিলেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল কিছুটা স্তিমিত হলে আমরা দুজন কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। সেখানেই বিতাড়ন, ধর্ষণ, হত্যা আর অগ্নিসংযোগের শিকার মানুষের কাছ থেকে সরাসরি তাদের করুণ অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম। আজও সেই গণহত্যা থামেনি। রোহিঙ্গারা অধিকারহীন, আশ্রয়হীন এবং নিজভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোনো নিশ্চয়তাও তাদের নেই। একই পরিণতির শিকার হয়েছে ফিলিস্তিনিরাও।
এই আট বছরে স্পষ্ট হয়েছে, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, তা কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ন্যায়বিচারের নামে গড়া সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ‘আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত’ (আইসিজে)ও অপরাধী রাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ব্যর্থ। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে এ ব্যর্থতা আসলে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য দায়মুক্তির সুযোগ তৈরি করেছে, আর সেই দৃষ্টান্ত বিশ্বের অন্যত্রও প্রভাব ফেলছে।
ইসরাইলের ফাঁস হওয়া এক সামরিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গাজায় হামাসবিরোধী অভিযানে নিহতদের ৮৩ শতাংশই সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ, কথিত ‘আরবান ওয়ারফেয়ার’ মূলত বেসামরিক হত্যাযজ্ঞেই পরিণত হয়েছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধেও একইভাবে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক তদন্ত চলছে। আইসিজে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে নিশ্চিত করে যে, দেশটিতে গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন হয়েছে। তখনই ইয়াঙ্গুনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রিত জনগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করে তাদের ওপর নতুন করে কোনো সহিংসতা চালানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবে উল্টোভাবে দায়মুক্তি বেড়েছে। গণহত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘ-সমর্থিত এই আদালত যে ব্যর্থ, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা নিপীড়ন বিচারপ্রক্রিয়ার চেয়ে দ্রুততর গতিতে এগিয়েছে।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে সুচি ও তার নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়। এরপর থেকেই জান্তা সরকার ক্যু-বিরোধী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ওপর গণহত্যা চালাতে থাকে। সেই সঙ্গে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীও উত্থান ঘটায়, যারা আবারও রোহিঙ্গাদের নিশানা বানায়।
রাখাইন অঞ্চলের অধিকাংশ এখন নিয়ন্ত্রণে ‘আরাকান আর্মি’ নামের একটি বৌদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠীর। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে প্রমাণ আছে, তারাই এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, তীব্র ইসলামবিদ্বেষী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবেই এ নিপীড়ন হচ্ছে।
যদিও সাধারণ মানুষ মূলত সেনাবাহিনীকে দায়ী করছে, কিন্তু রাজনৈতিক দল, বৌদ্ধ সংগঠন বা সুশীল সমাজের যে অংশ এই গণহত্যায় সহযোগী, তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।
২০১৪ সালে আমরা তিন বছরব্যাপী এক গবেষণায় দেখিয়েছিলাম, রোহিঙ্গাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে বিতাড়ন, নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। তখনই আমরা ‘নীরব গণহত্যা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করি, যার অর্থ—রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সচেতনভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা। এতে সহিংসতাকে বৈধতা দিতে আন্তর্জাতিক আইনকেও ব্যবহার করা হয়।
মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে ইসলামোফোবিক প্রচারণা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে গণহত্যা চালানো হলেও তেমন কোনো নাগরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি। একসময় গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে প্রশংসিত সুচি ২০২০ সালে আইসিজেতে গিয়ে উল্টো এই গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। এরই মধ্যে নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে ৬০০ রোহিঙ্গাকে হত্যার একটি বধ্যভূমি, যার সঙ্গে আরাকান আর্মি জড়িত। কিন্তু মিয়ানমারের কোনো রাজনৈতিক দল বা সশস্ত্র সংগঠন এ নিয়ে প্রতিবাদ জানায়নি।
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত গোষ্ঠীগুলোর কাছে গণহত্যা প্রতিরোধের চেয়ে আরাকান আর্মির সহযোগিতা পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ গণহত্যার সময় নীরব থাকা মানে আসলে তাতে অংশগ্রহণ করা। সুচির পতনের পরও মিয়ানমারের জনগণ কোনো শিক্ষা নেয়নি। গণহত্যার সমর্থক হওয়ার কারণে তিনি আজ বিশ্বজুড়ে সমর্থন হারিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে।
মিয়ানমারের বাইরে আরও অনেক নেতা আন্তর্জাতিক সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে দায়মুক্তি ভোগ করছেন। আমরা এমন এক ভয়াবহ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। গণহত্যা প্রতিরোধে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বরং যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে প্রশংসা করছে এবং যেসব আইসিসি কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোও একই পথে হাঁটছে।
BD/AN