বাগেরহাট জেলার চারটি সংসদীয় আসনে বিএনপির ঘোষিত মনোনয়ন ঘিরে প্রত্যাশার চেয়ে বিতর্ক ও সমালোচনাই বেশি দেখা যাচ্ছে। ঘোষিত চার প্রার্থীর মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা হওয়ায় জেলা বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ, হতাশা ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য মাঠে কাজ করা নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মাত্র এক বছর আগে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিলে দল সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ওই প্রার্থীদের অতীতের ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি আরও আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে এবং সমালোচনার মাত্রা বেড়ে যায়।
বাগেরহাট-১ (ফকিরহাট-মোল্লাহাট-চিতলমারী) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল। তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব এবং বাংলাদেশ অশ্বিনী সেবা আশ্রমের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। অতীতে তিনি চিতলমারী উপজেলার কলাতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে, বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্যজোটের সভাপতি সোমনাথ দে। তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাবেক সভাপতি এবং মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন। এর আগে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সংখ্যালঘুবিষয়ক উপদেষ্টা এবং মোরেলগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগে কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল গ্রেফতার হন। অপরদিকে, অন্য একটি মামলায় কারাভোগ করেন সোমনাথ দে। কারামুক্ত হওয়ার পর গত ২০ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন তারা দুজন। শনিবার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিএনপি কর্মী জিল্লুর রহমান ডিয়ার বলেন, গত ১৭ বছরে যারা রাজপথে থেকে দলের জন্য কাজ করেছেন, জেল-জুলুম, হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন—তাদের উপেক্ষা করে বাগেরহাটের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই ‘অতিথি পাখি’দের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি এসব মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানান।
আরেক কর্মী মো. শিমুল বলেন, বছরের পর বছর রাজপথে সক্রিয় থেকেও যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের বাদ দিয়ে হঠাৎ দলে আসা ব্যক্তিদের প্রার্থী করা হয়েছে। বিএনপির ত্যাগী সমর্থকেরা এই সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নেবে না।
বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এটিএম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, মনোনয়নের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয় হওয়ায় জেলা পর্যায়ে আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গভীর বেদনা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানো হয়েছে।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এমএ সালাম বলেন, আওয়ামী লীগের পদধারী ও সুবিধাবাদী নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। তিনি বাগেরহাট-২ আসনের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানান।
বাগেরহাট-১ আসনের প্রার্থী কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল দাবি করেন, তিনি কখনো সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন এমপি ও মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, সেই সময়ের ছবিগুলোকে কেন্দ্র করে এখন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, বাগেরহাট-৪ আসনের প্রার্থী সোমনাথ দে বলেন, তার মনোনয়ন পাওয়ায় চাঁদাবাজ ও জুলুমকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তিনি স্বীকার করেন যে অতীতে তিনি জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং কারাভোগও করেছেন। সবকিছু জেনেই দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। নির্বাচিত হলে এলাকায় অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করবেন বলেও আশ্বাস দেন।
এদিকে, বাগেরহাট-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থী কাজী খায়রুজ্জামান শিপনের কর্মী-সমর্থকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। একইভাবে বাগেরহাট-২ আসনে মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে রোববার রাতে শহরের শহীদ মিনার চত্বর থেকে মশাল মিছিল করেন মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থী এমএ সালামের সমর্থকেরা। মিছিল শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা বর্তমান মনোনয়ন বাতিল করে এমএ সালামকে দলীয় প্রার্থী করার দাবি জানান। দাবি মানা না হলে রাজপথে কঠোর আন্দোলন ও সংগ্রামের হুঁশিয়ারিও দেন তারা।































