ঐতিহাসিক মহৌষধ রসুন: রান্নাঘরের উপাদান থেকে জীবনরক্ষাকারী

Published : ০০:৪৯, ১০ জুলাই ২০২৫
আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা জটিল ওষুধ আবিষ্কারের বহু আগে, যখন চিকিৎসাবিজ্ঞান এতটা অগ্রসর ছিল না, তখন মানবসভ্যতার অন্যতম আস্থার জায়গা ছিল রান্নাঘরের এক পরিচিত উপাদান—রসুন। শুধু স্বাদের জন্য নয়, রসুন ছিল এককথায় প্রাকৃতিক ফার্মেসি। প্রাচীন সভ্যতায় রসুনের পদচিহ্ন ,রসুনের ব্যবহার ও গুরুত্ব খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালের মিশরীয় ফ্যারাওদের সমাধি থেকেই জানা যায়। সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয়রা রসুনকে শুধু খাবার নয়, মহৌষধ হিসেবে বিবেচনা করত। এমনকি সুমেরীয়রাই সম্ভবত প্রথম রসুন চীনে নিয়ে যায়, যেখান থেকে তা জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।, গ্রীকদের মধ্যে এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের যুদ্ধের আগে রসুন খাওয়ানো হতো। অলিম্পিক ক্রীড়াবিদরাও রসুন খেয়ে পারফরম্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করতেন। হিপোক্রেটিস, থিওফ্রাস্টাস, ডায়োস্কোরাইডস প্রমুখ চিকিৎসাবিদরা বিভিন্ন অসুখে রসুনের ব্যবহার উল্লেখ করেছেন। এমনকি সাপের কামড়, পাগলা কুকুরের আক্রমণ কিংবা কোলিক ব্যথা উপশমে রসুন ব্যবহার হতো। ,মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, রসুন আত্মার সুরক্ষা ও পরকালীন শক্তি প্রদান করে—এই বিশ্বাসে তারা ফ্যারাওদের সমাধিতে রসুন রেখে দিত। তিব্বতি, ইসরায়েলি, আরব ও স্লাভিক সভ্যতায়ও রসুনের দারুণ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তালমুদে রসুন দিয়ে খাবারের উল্লেখ রয়েছে। ব্যাবিলনে রসুন পরিচিত ছিল ‘র্যাঙ্ক গোলাপ’ নামে।, মহামারি ও যুদ্ধের কালেও রসুনের গুরুত্ব ১৬৬৫ সালে লন্ডনের প্লেগ মহামারী চলাকালে চিকিৎসকরা রসুন ব্যবহারে উৎসাহিত করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রসুন ব্যবহৃত হয়েছিল ক্ষতস্থানে এবং আমাশা চিকিৎসায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, যখন পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক মজুদ ছিল না, তখন রাশিয়ান পেনিসিলিন নামে পরিচিত রসুন দিয়ে চিকিৎসা করা হতো। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার সময় ফরাসি ফাইটোথেরাপিস্ট লেক্রেক রসুন ব্যবহার করেন প্রতিরোধক হিসেবে। সে সময় আমেরিকায় অনেকে রসুনের মালা পরে ঘরের বাইরে বের হতেন। ,আধুনিক বিজ্ঞান যা বলে, বর্তমান গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, রসুনে আছে অ্যালিসিন, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ। এতে আছে ভিটামিন C, B1, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম সহ আরও অনেক খনিজ। রসুনের প্রমাণিত উপকারিতা ১. প্রদাহ কমায় এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে ২. লিভারকে রক্ষা করে ও রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে ৩. ব্যাকটেরিয়া রোধ করে, অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে ৪. রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে ৫. ভারী ধাতুর বিষক্রিয়া থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে রক্ষা করে ৬. চুল পড়া ও পাকা চুল নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে ৭. বাতের ব্যথা, স্পন্ডেলাইটিস, ফ্রোজেন শোল্ডার ইত্যাদিতে উপকারী ৮. সর্দি-কাশি, হুপিং কাশিতে কার্যকর ৯. কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস ও ইনডাইজেশনে ভালো ফল দেয় ১০. বিছা বা পোকামাকড়ের কামড়ে রসুন থেঁতো করে লাগালে উপশম হয় , যাদের কাঁচা রসুন সহ্য হয় না , তারা রসুনের আচার, রসুন ভেজে বা রসুন-চা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। গরম ভাতে ঘিয়ে ভাজা রসুন খেলে সাইনাস ও ঠান্ডাজনিত সমস্যা কমে। মধু ও রসুন একসঙ্গে খেলে ডায়রিয়া ও ভাইরাস ইনফেকশন রোধে উপকার মেলে। রসুনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজকের দিনে, রসুন শুধু খাবার নয়—প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবেও পরিচিত। তাই একে ডাকা হয়: ‘প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক’, ‘রাশিয়ান পেনিসিলিন’, ‘উদ্ভিদ ভায়াগ্রা’, ‘স্নেক গ্রাস’ ইত্যাদি নামে। প্রতি বছর ১৯ এপ্রিল পালিত হয় জাতীয় রসুন দিবস, যা রসুনপ্রেমীদের জন্য এক ব্যতিক্রমী উদযাপন। চাষ ও উৎপাদন : বিশ্বের ৮০ শতাংশ রসুন চাষ হয় চীনে, এরপর ভারত অন্যতম বৃহৎ উৎপাদনকারী দেশ। ক্যালিফোর্নিয়ার গিলরয় শহরকে বলা হয় ‘বিশ্বের রসুনের রাজধানী’।
রসুনের গন্ধ যতই তীব্র হোক না কেন, মানবসভ্যতা বারবার প্রমাণ করেছে—এই ছোট্ট কন্দটিই হতে পারে অসংখ্য রোগ থেকে মুক্তির চাবিকাঠি। রান্নাঘর থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্র, মহামারি থেকে চিকিৎসাগার—সবখানেই রসুন নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। রসুন শুধু খাদ্য নয়, একটি ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার প্রতীক।
BD/S