মৌসুমী ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা কী, লক্ষণ ও প্রতিকার কী?

Published : ০২:০৯, ৫ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর শীত মৌসুম এলেই নতুন করে আলোচনায় আসে একটি পরিচিত রোগ—মৌসুমি ফ্লু, যা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগ। তবে গত কয়েক বছর ধারে দেখা যাচ্ছে, এটি কেবল শীতকালের সীমায় আবদ্ধ নেই; বরং গ্রীষ্মকাল বা বর্ষাকালেও এর প্রকোপ বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই রোগের লক্ষণগুলো অনেক সময় সাধারণ সর্দি-কাশির মতো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি অনেক বেশি জটিল ও মারাত্মক হতে পারে, বিশেষত শিশু, বয়স্ক ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। ইনফ্লুয়েঞ্জা বা মৌসুমি ফ্লু হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা A ও B নামক দুটি ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ভাইরাল রেসপিরেটরি ইনফেকশন (Viral Respiratory Infection)। এই ভাইরাস মূলত নাক, গলা এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে।
এটি মানুষ থেকে মানুষে সহজে ছড়ায় এবং কিছু ক্ষেত্রে ভয়াবহ জটিলতা তৈরি করতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, কথা বলা বা হাত দিয়ে মুখ-নাক স্পর্শ করার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং আশপাশের ব্যক্তিদের সংক্রমিত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত ব্যক্তি লক্ষণ দেখা দেওয়ার ১ দিন আগে থেকে এবং ৫–৭ দিন পর পর্যন্ত অন্যদের সংক্রমিত করতে পারেন। শিশু এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সময়কাল আরও দীর্ঘ হতে পারে।
লক্ষণসমূহ (Symptoms) ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং রোগীর শরীরে সাধারণত নিচের উপসর্গগুলো দেখা যায়: উচ্চ জ্বর (১০১°F বা তার বেশি), শুষ্ক ও তীব্র কাশি, গলা ব্যথা, সর্দি ও নাক বন্ধ হওয়া, মাথাব্যথা, পেশি ও শরীরব্যথা, অতিরিক্ত ক্লান্তি ও অবসাদ, চোখে জ্বালাপোড়া বা পানিপড়া, শিশুদের ক্ষেত্রে বমি বা ডায়রিয়া । অনেক সময় এই লক্ষণগুলো সাধারণ ঠান্ডার মতো মনে হলেও ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো অধিক তীব্র হয় এবং শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে? ইনফ্লুয়েঞ্জা যে কারও হতে পারে, তবে নিচের গোষ্ঠীগুলো বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ: ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা, ৫ বছরের কম বয়সী শিশু, গর্ভবতী নারী, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বা ক্যান্সারের চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি নিচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ধূমপায়ী ও ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্তরা, এইসব গোষ্ঠীর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা জটিল রূপ নিতে পারে—যেমন নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, সাইনাস ইনফেকশন বা এমনকি মৃত্যুও।
কেন ইনফ্লুয়েঞ্জা গুরুতর? যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফ্লু কয়েকদিনের মধ্যে সেরে যায়, কিন্তু কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এটি দ্রুত ফুসফুসের সংক্রমণ, সেপসিস, মাল্টি-অর্গান ফেলিওর কিংবা ক্রিটিক্যাল নিউমোনিয়াতে রূপ নিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে প্রায় ২.৯ থেকে ৬.৫ লাখ মানুষ মারা যায়।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা ঃ ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে নিচের পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত কার্যকর: টিকা (Influenza Vaccine) গ্রহণ: প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ভিন্ন ভিন্ন স্ট্রেনের ভিত্তিতে নতুন ভ্যাকসিন তৈরি হয়। WHO ও CDC এর সুপারিশ অনুযায়ী, প্রত্যেকেরই প্রতিবছর ফ্লু টিকা নেওয়া উচিত, বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ: হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা (টিস্যু বা কনুইয়ের ভিতর দিয়ে) বারবার সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া , ব্যবহৃত টিস্যু বা মাস্ক যথাযথভাবে ফেলা ।
অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা, ঘরের জানালা খুলে বাতাস চলাচলের সুযোগ রাখা, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় সাধারণত উপসর্গ-নির্ভর ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ যেমন Oseltamivir (Tamiflu) প্রেসক্রাইব করতে পারেন।
বাড়িতে যা করণীয়: বিশ্রাম নেওয়া, প্রচুর তরল গ্রহণ, গরম পানির ভাপ নেওয়া, সর্দি/কাশির জন্য উপযুক্ত সিরাপ বা প্যারাসিটামল গ্রহণ (ডাক্তারের পরামর্শে) ,যদি ৩–৫ দিনের মধ্যে জ্বর না কমে বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া , বিশেষ সতর্কতা শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে, শিশুদের মধ্যে ফ্লুর কারণে অতিরিক্ত জ্বর, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা, খিঁচুনি বা পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে জ্ঞান হারানো, শ্বাসকষ্ট বা চেতনা হারানো হতে পারে, যা তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন তৈরি করে।
মৌসুমি ফ্লুকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এটি একটি মারাত্মক ভাইরাল সংক্রমণ, যা সঠিক সময়ে শনাক্ত ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে প্রাণঘাতী হতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বার্ষিক টিকা গ্রহণ, এবং উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া—এই তিনটি পদক্ষেপই হতে পারে নিরাপদ ও সুস্থ থাকার মূলমন্ত্র। তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)
S