আরেকটি জেন-জির ঝড়ে বিশ্ব আবারও দেখলো এক সফল বিপ্লবের পরিণতি। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর এবার পালা নেপালের। মাত্র দুই দিনের ভয়াবহ গণঅভ্যুত্থানে ভেঙে পড়েছে দেশটির পুরো শাসন কাঠামো। মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িঘর, সরকারি দপ্তর এমনকি সংসদ ভবনের আশপাশেও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ তরুণরা। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে শেষ পর্যন্ত নেপালের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগে বাধ্য হন। সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, নয়তো লাপাত্তা হয়ে আত্মগোপনে আছেন।
এখন কার্যকর কোনো সরকার নেই নেপালে। দেশজুড়ে নেমে এসেছে অরাজকতা। কারফিউ জারি করেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নিয়েছে নতুন সরকার গঠনের লক্ষ্যে।
মূলত, সরকারের সিদ্ধান্তে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ হওয়ার পর যে আন্দোলনের সূচনা করে নেপালের জেন-জি প্রজন্ম, তা আর সাধারণ প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ বা এক্স-এর স্বাধীনতা ফেরত পাওয়ার দাবি থেকে আন্দোলনের বিস্তার ঘটে আরও গভীরে—স্বজনপ্রীতি, দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব কারণেই এবার ক্ষোভের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। বিশেষত, তাদের বিলাসী জীবনযাত্রা সাধারণ তরুণদের ক্ষোভকে বিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দেয়। যেখানে সাধারণ নেপালি যুবক-যুবতীরা বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে, সেখানে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা দামি গাড়ি, ফ্যাশনেবল পোশাক আর বিদেশ ভ্রমণের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, রেডিট ও এক্স-এ নেপো কিডদের এই প্রদর্শনী ভাইরাল হয় বিক্ষোভ শুরুর আগে। বিশেষ করে #PoliticiansNepoBabyNepal এবং #NepoBabies হ্যাশট্যাগ কয়েক লক্ষ ভিউ পায়, যেখানে পাশাপাশি ভেসে ওঠে অভিজাতদের বিলাসিতা ও সাধারণ মানুষের দুর্দশা।
তাদের মধ্যেই আলোচনায় আসেন শৃঙ্খলা খাতিওয়াড়া—প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিরোধ খাতিওয়াড়ার কন্যা, যিনি একসময় মিস নেপাল ছিলেন। তার বিলাসী ছবি ভাইরাল হতেই বিক্ষোভকারীরা তার বাবার বাড়িতে আগুন দেয়। শৃঙ্খলা এক ঝটকায় হারান ইনস্টাগ্রামে এক লাখেরও বেশি অনুসারী।
এভাবেই আলোচনায় আসেন আরেকজন—শিবানা শ্রেষ্ঠা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার পুত্রবধূ ও জনপ্রিয় গায়িকা তিনি। নিজের বিলাসবহুল বাড়ি ও দামি ফ্যাশনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করায় বিক্ষোভকারীদের টার্গেটে পরিণত হন তিনি ও তার স্বামী জয়বীর সিং দেউবা।
প্রচণ্ডর নাতনি স্মিতা দহলও এই ক্ষোভের শিকার হন। তার সামাজিক মাধ্যমে শৌখিন হ্যান্ডব্যাগ প্রদর্শন সাধারণ তরুণদের ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়, এমনকি প্রচণ্ডর বাড়িতেও হামলা হয়।
তালিকায় আছেন সৌগত থাপা, আইনমন্ত্রী বিন্দু কুমার থাপার ছেলে। তিনিও নিজের বিলাসী জীবনযাপন অনলাইনে প্রদর্শনের কারণে আন্দোলনকারীদের চোখে আঙুল দিয়ে ক্ষোভ উসকে দেন।
এর পেছনে দুর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে নেপালকে ধারাবাহিকভাবে এশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় রাখা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের তদন্তে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে ৭১ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ উঠে আসে। এছাড়া ভুটান থেকে বাস্তুচ্যুত নেপালিদের জন্য নির্ধারিত শরণার্থী কোটার বাণিজ্যের সঙ্গেও রাজনীতিকদের সম্পৃক্ততা প্রকাশ্যে এসেছে।
সব মিলিয়ে, এই দুর্নীতি, বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির আগুনেই জ্বলে উঠেছে নেপালের জেন-জি প্রজন্ম। এখন তারা সংবিধান সংশোধনের দাবি তুলছে এবং কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ওপরই আস্থা রাখতে পারছে না। হিমালয় কন্যা নেপাল তাই দাঁড়িয়ে গেছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দোরগোড়ায়।