নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সম্প্রতি হাজার হাজার তরুণ, বিশেষ করে জেনারেশন জেড বা জেন-জেডের তরুণরা রাস্তায় নেমে তীব্র বিক্ষোভ করেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে অন্তত ৫১ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তই এ আন্দোলনের মূল কারণ।
বন্ধ হওয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে ছিল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও লিঙ্কডইনের মতো জনপ্রিয় মাধ্যম। সরকারের এ পদক্ষেপে নাগরিকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সড়ক-রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে।
নেপালের এই ঘটনাই আবারও প্রমাণ করল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল মানুষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং নাগরিকদের অধিকার আদায়ের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। গত দেড় দশকে বিশ্বের নানা প্রান্তে অসংখ্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমের জোরে। আজকের প্রতিবেদনে তারই কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ তুলে ধরা হলো।
তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লব (২০১০-১১)
সামাজিক মাধ্যমে সংগঠিত প্রথম বড় বিপ্লব হিসেবে পরিচিত ‘জেসমিন বিপ্লব’। দীর্ঘ ২৩ বছর ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক জিন এল আবেদিন বেন আলি শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে ক্ষমতা হারান। বেকারত্ব, দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাবের বিরুদ্ধে তরুণদের নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ শুরু হয়।
ডিসেম্বর ২০১০-এ মোহাম্মদ বৌয়াজিজি নামে তরুণ এক ফেরিওয়ালা পুলিশের হয়রানি সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেন। মুহূর্তের মধ্যেই তার আত্মদাহের খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক ও ইউটিউবের ভিডিও ও ছবিগুলো জনমতকে উত্তাল করে তোলে। অবশেষে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি বেন আলি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
আরব বসন্ত (২০১১)
তিউনিসিয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে গণজাগরণ। লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়ায় ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত বিপ্লব শুরু হয়। মিসরে আন্দোলনকে বলা হয়েছিল ‘টুইটার বিপ্লব’। হ্যাশট্যাগ, টুইট এবং ফেসবুক পোস্ট আন্দোলন সংগঠিত করার মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ফলেই ক্ষমতা হারান মুয়াম্মার গাদ্দাফি, হোসনি মুবারক ও আলি আবদুল্লাহ সালেহর মতো শাসকরা।
ইউক্রেনের ইউরোমাইডান আন্দোলন (২০১৩-১৪)
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করেন, তখন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। কিয়েভের স্বাধীনতা চত্বর হয়ে ওঠে প্রতিবাদের কেন্দ্র। ফেব্রুয়ারি ২০১৪-তে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১০০ জন নিহত হন। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ঘটনাবলিই বিক্ষোভকে আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত ইয়ানুকোভিচ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
লেবাননের হোয়াটসঅ্যাপ বিপ্লব (২০১৯)
২০১৯ সালে লেবানন সরকার হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য সেবায় কর আরোপের ঘোষণা দিলে নাগরিকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে তরুণরা রাস্তায় নেমে পড়েন। বিক্ষোভের চাপ বাড়তে থাকলে প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরি পদত্যাগ করেন। যদিও কাঠামোগত রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়নি, তবুও এই আন্দোলন ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিপ্লব’ নামে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।
শ্রীলঙ্কার গণবিক্ষোভ (২০২২)
অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় জনগণ সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। #GoHomeGota হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে গোতাবয়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি তীব্র হয়ে ওঠে। জুলাই মাসে হাজারো মানুষ প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে সমবেত হলে রাজাপক্ষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন (২০২৪)
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে বিশাল জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারের কঠোর দমননীতি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক মাধ্যমে লাইভ সম্প্রচার, পোস্টার ও স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিদেশ থেকেও সমর্থন আসে। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। শিক্ষার্থীদের ঐক্য ও সামাজিক মাধ্যমের শক্তিই ছিল এ ঘটনার পেছনের প্রধান চালিকা শক্তি।
ইন্দোনেশিয়ার যুববিক্ষোভ (২০২৫)
২০২৫ সালে জাকার্তায় এমপি ভাতা বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির কারণে তরুণরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাজনীতিবিদদের বিলাসী জীবনযাত্রার ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষোভ আরও বাড়ে এবং আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
সামাজিক মাধ্যম: আধুনিক যুগের আন্দোলনের হাতিয়ার
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো আজকের যুগে সামাজিক মাধ্যম কেবল তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম নয়। এটি নাগরিকদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর, আন্দোলনের সংগঠক এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতায় বাধ্য করার শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।
নেপালের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ আবারও দেখিয়ে দিল, সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে মানুষের কণ্ঠ রোধ করা যায় না। বরং এ ধরনের পদক্ষেপ আরও বড় বিস্ফোরণ ডেকে আনে। আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ, ইউক্রেন থেকে শ্রীলঙ্কা—সবখানেই প্রমাণিত, যখন নাগরিকরা অধিকার আদায়ে একত্র হয়, তখন সামাজিক মাধ্যমই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে ওঠে।