গত ২১ নভেম্বর (শুক্রবার) বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
আকস্মিক এই কম্পন মানুষকে ব্যাপকভাবে আতঙ্কিত করে তোলে। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সেই ভয়ের প্রভাব পুরোপুরি কাটেনি। এর মধ্যেই সাত দিনের ব্যবধানে আরও ছয়বার ভূমিকম্প হওয়ায় দেশের মানুষ এক ধরনের মানসিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। ফলে ভূমিকম্প সম্পর্কে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ এখনো মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পকে যতটা ভয়াবহ ঘটনা মনে করা হয়, বিশ্বের কিছু দেশে এটি প্রায় দৈনন্দিন বিষয়।
উদাহরণ হিসেবে তাঁরা জাপানের কথা উল্লেখ করছেন—দেশটি বাংলাদেশের পূর্বদিকে অবস্থিত এবং সেখানে বছরে প্রায় দেড় হাজার ভূমিকম্প ঘটে থাকলেও মানুষ আতঙ্কিত হয় না। সাম্প্রতিক কম্পনের পর বাংলাদেশে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে জাপান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
জাপানে ভূমিকম্প এত ঘন ঘন হওয়ার কারণ
জাপান যে কারণে প্রায় নিয়মিত ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়, তা মূলত ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। জাপান অবস্থিত প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ অঞ্চলে। এখানে ইউরেশিয়ান, ফিলিপাইন ও প্যাসিফিক—এই তিনটি বড় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে। প্লেটগুলোর ঘন ঘন নড়াচড়া এই অঞ্চলে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করে, যাকে জাপানের মানুষ প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখে।
জাপানের প্রস্তুতি: যেখান থেকে বাংলাদেশের শেখার আছে
বাংলাদেশে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় কিছু প্রস্তুতি থাকলেও ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সে রকম উদ্যোগ তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাপানের সতর্কতা ও সচেতনতা বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হতে পারে।
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব জানান, জাপানে একটি শিশু জন্মের পর থেকেই ভূমিকম্পের আচরণ, নিরাপদ অবস্থান ও তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে জানতে শেখে।
স্কুলে তারা নিয়মিত মহড়ায় অংশ নেয়—যেখানে ডেস্কের নিচে আশ্রয় নেওয়া থেকে শুরু করে ভূমিকম্পের পর কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, সবই শেখানো হয়। এসব মহড়ায় অধিক অর্থ ব্যয় হয় না, কিন্তু সচেতনতা গড়ে ওঠে কার্যকরভাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আখতারও মনে করেন, বাংলাদেশে নিয়মিত মহড়া চালু করা গেলে জনগণের আতঙ্ক অনেকটাই কমে যাবে।
জাপানে প্রত্যেক মানুষের জানাশোনা থাকে তাদের নিকটতম নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র—যেমন পার্ক বা খেলার মাঠ—কোথায় অবস্থিত। একই ধরনের ব্যবস্থা ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতেও গড়ে তুলতে হবে বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।
জাপানের ভবন কেন এত স্থিতিশীল?
জাপানে বছরে শত শত কম্পন সহ্য করেও আকাশচুম্বী ভবনগুলো টিকে থাকে। এর পেছনে রয়েছে বিশেষ নির্মাণ প্রযুক্তি। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার জুন সাতো জানান, জাপানে ছোট-বড় সব ভবনই বাধ্যতামূলকভাবে ভূমিকম্প-সহনশীল করে নির্মাণ করতে হয়। বড় ভবনগুলো এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে কম্পনের সময় শক্তভাবে কাঁপা নয়, বরং দুলে চাপ সামলাতে পারে।
এক্ষেত্রে ভবনগুলোকে ‘সিসমিক আইসোলেশন’ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়। মাটির নিচে ৩০–৫০ সেন্টিমিটার পুরু রাবারের বেয়ারিং বা শক অ্যাবজরবার বসিয়ে ভবনের ওপরের কাঠামোকে কম্পনের ধাক্কা থেকে রক্ষা করা হয়।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বিশেষজ্ঞ জিগি লুবকোভস্কি বলেন, ভবনে ব্যবহৃত মোশন ড্যাম্পারগুলো অতিরিক্ত নড়াচড়া কমিয়ে কাঠামোর ক্ষতি ঠেকায়।
বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশে উচ্চ ভবন নির্মাণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এখনো সীমিত হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো সচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়মিত মহড়া এবং ছোট ভবনগুলোতেও বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে প্রয়োগ করা।
স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে, ব্যক্তিমালিকানাধীন ছোট ভবনেও বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আর ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের জন্য একটি সুসংহত রেজিলিয়েন্স প্ল্যান বা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করা সময়ের দাবি।
সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, ভূমিকম্প মোকাবিলায় জাপানের প্রযুক্তি, সচেতনতা এবং প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হতে পারে—বিশেষ করে সাম্প্রতিক কম্পনের পর মানুষের যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
(সূত্র: বিবিসি বাংলা)
ChatGPT































