সময়কে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যতটা নির্দিষ্ট ও স্থির মনে করি, বাস্তবে আমাদের মস্তিষ্ক সেটিকে ঠিক ততটাই ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে।
সেকেন্ড, মিনিট বা ঘণ্টা কখনো ধীর, কখনো দ্রুত মনে হওয়া—এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে আমাদের মানসিক প্রক্রিয়া ও স্নায়ুবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম কার্যক্রমে।
১. নতুন অভিজ্ঞতা বনাম একঘেয়ে রুটিন: স্মৃতির ওপর সময়ের গতির প্রভাব
আমাদের স্মৃতি তৈরির ধরনই ঠিক করে দেয় সময়কে আমরা দ্রুত বা ধীরে অনুভব করব কি না।
নতুন অভিজ্ঞতায় সময় ধীরে চলে মনে হয়:
কোনো ভ্রমণ, শেখার নতুন মুহূর্ত বা অচেনা পরিবেশে থাকলে মস্তিষ্ককে নিত্যনতুন তথ্য প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রতিটি দৃশ্য, শব্দ, ঘটনা সে আলাদাভাবে ধারণ করে, ফলে দিনের শেষে মনে হয় অনেক কিছু ঘটেছে—সময় যেন দীর্ঘ ছিল। এ কারণেই ‘হলিডে প্যারাডক্স’ নামে পরিচিত ধারণাটিতে বলা হয়, নতুন অভিজ্ঞতায় সময়কে ধীর মনে হয়।
একঘেয়ে রুটিনে সময় দ্রুত পালায়:
একই কাজ, একই পথ, একই পরিবেশ—এই পুনরাবৃত্তির মধ্যে নতুন কোনো স্মৃতি তৈরি হয় না বললেই চলে। মস্তিষ্ক কাজগুলো অটোপাইলটে সামলে নেয়। তাই পিছনে তাকালে মনে হয় সপ্তাহ যেন হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে।
২. আবেগের তীব্রতা: আনন্দ-দুঃখে সময়ের ভিন্ন অনুভূতি
আমাদের আবেগ সময়ের অনুভূতিকে গভীরভাবে বদলে দেয়।
আনন্দে সময় দ্রুত:
আনন্দ, উত্তেজনা বা প্রিয় মানুষের সঙ্গ—মনে মনোযোগ থাকে মুহূর্তের উপভোগে, সময়ের দিকে নয়। তাই হঠাৎই মনে হয়—সময় উড়ে গেল।
দুঃখ বা উদ্বেগে সময় থমকে যায়:
অপেক্ষা, যন্ত্রণা বা উদ্বেগে মস্তিষ্ক বিপদের আশঙ্কায় তীব্র সতর্ক অবস্থায় থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত সে আলাদা করে লক্ষ্য করে। ফলে সময় যেন একেবারে নড়তে চায় না।
৩. বয়স বাড়লে কেন সময় দ্রুত মনে হয়
বয়স বাড়ার সঙ্গে সময় দ্রুত অনুভূত হওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানীরা ‘টেম্পোরাল ডিজঅর্ডার’ বা সময়-বোধের পরিবর্তন বলে ব্যাখ্যা করেন।
শিশুর জীবনে এক বছর তার মোট জীবনের বড় অংশ—তাই বছরটি দীর্ঘ মনে হয়।
বয়স্কদের জীবনে নতুনত্ব কমে যায়, বছরের অনুপাতও তুলনামূলক ছোট হয়ে যায়। ফলে বছরগুলো যেন হু হু করে কেটে যায়।
৪. মনোযোগের প্রভাব: কাজে নিমগ্নতা সময়ের গতিকে বদলে দেয়
গভীর মনোনিবেশে কাজ করলে সময় দ্রুত অনুভূত হয়।
অন্যদিকে বিরক্তিকর বা মনোযোগহীন কাজে সময় ধীরে কাটে—মস্তিষ্ক ঘনঘন ‘সময়’ যাচাই করে, ফলে মনে হয় সময় এগোচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত সময় একই গতিতে চলে, কিন্তু আমাদের মন ও স্মৃতিই প্রতি মুহূর্তে এর ভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরি করে। নতুন অভিজ্ঞতা, শেখা এবং মুহূর্তকে সচেতনভাবে উপভোগ করলে সময়কে দীর্ঘতর মনে হয়—এটাই সময়কে ‘উপলব্ধি’ করার মানবিক বিজ্ঞান।
































