রংপুরে ইজিবাইক চার্জে মাসে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে

রংপুরে ইজিবাইক চার্জে মাসে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ছবি: বিজনেস ডেইলি

বিজনেস ডেইলি ডেস্ক

Published : ২১:২৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

রংপুরে মাসে ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও অটোচার্জে। শুধু বিদ্যুৎ খরচ নয়, অদক্ষ চালকের কারণে অকালেই ঝড়ে যাচ্ছে অনেকের প্রাণ। ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে মানুষকে। চলতি বছরের গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় বিদ্যালয় ছুটির পর রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় দ্রুতগামী ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকের ধাক্কা দেয় ছোট্টশিশু দারুল জান্নাত দিনাকে। এতে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়।

তাকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। নিহত দারুল জান্নাত দিনা মাহিগঞ্জ এলাকার আমতলা বিদ্যাপীঠ অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। প্রশিক্ষণবিহীন এসব যানবাহনের চালকগণ থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও।

সময় বাঁচানোর জন্য তারা দ্রুতগতিতে জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রতিনিয়ত যানবাহন চালানো হচ্ছে। দোলন মিয়া বলেন, তার মেয়ে দিনা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় মারা গেছেন। অটোচালক ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। অন্যের অটোরিকশা নিয়ে সেদিন সড়কে যাত্রী নিয়ে দ্রুত ছুটতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে।

এমন অনেক অদক্ষ, অনভিজ্ঞ, অটোচালকদের কারণে প্রতিদিনই কোথাও কোথাও ছোট-বড় নানা রকম দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন অসংখ্য দুর্ঘটনায় বেড়েছে মৃত্যুর হার ও পঙ্গুত্ব। গত কয়েক বছরে রংপুরে আঞ্চলিক সড়ক ও মহাসড়কে ব্যাপকহারে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও অটোচার্জার রিকশার দাপট বেড়েছে। বিভাগীয় ও জেলা শহরে অদক্ষ চালকের কারণে যত্রতত্র বেড়েছে ব্যাপক যানজট। যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।

বেড়েছে বিদ্যুতের ওপর চাপ। এসব যানবাহনে সংঘটিত হচ্ছে নানা অপরাধ। শান্তির শহরগুলো যেন অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক অটোচার্জার রিকশার। রংপুর অঞ্চলের মহাসড়কগুলোতে দিন দিন বেড়ে চলেছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও চার্জাররিকশার দৌরাত্ম্য। এসব যানবাহন মহাসড়কে চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে চলছে উল্টো চিত্র। ফলে প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে চলাচল করছেন হাজারো যাত্রী, ঘটছে দুর্ঘটনা, হারাচ্ছে প্রাণ।

২০২৪ সালে সারাদেশে অন্তত ১ হাজার ২৪৮টি থ্রি হুইলার দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় ৬৯৬ জন, যা মোট মৃত্যুর ৮ দশমিক চার শতাংশ। অপরদিকে ২০২৫ সালের মার্চ মাসেই সারাদেশে ঘটে ৫৮৭টি দুর্ঘটনা, নিহত ৬০৪ জন। এর মধ্যে থ্রি হুইলার জড়িত ছিল অন্তত ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনা। নিহতদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ যাত্রীই ছিল অটোরিকশার আরোহী। রংপুরে করুণ উদাহরণ রয়েছে।

কিছুদিন আগে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে একসাথে ৫ জন নিহত হন রংপুরের মহাসড়কে। রংপুরের সাতমাথায় গত ৩১ জানুয়ারি যাত্রীবাহী বাস ও থ্রি হুইলারের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হন। গত ছয় মাসে রংপুরের মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে অর্ধশতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।

সড়ক-মহাসড়কে বিপদজনক অটোরিকশা

হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে রংপুর অঞ্চলের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ১৯৫টি দুর্ঘটনায় ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। শারীরিকভাবে অনেকই ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করলেও এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই মাসে সারা দেশে মোট ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮০ জন নিহত হয়েছে।

এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৫৪২ জন। এরমধ্যে শুধুমাত্র অটোরিকশা দুর্ঘটনায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রংপুর বিভাগে ব্যাটারি চালিত থ্রি-হুইলার ও অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে ৪৩ দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত হন।

অপরদিকে, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে সারা দেশে ৪৪৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৮ জন নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৮৫৬ জন। নিহত হয়েছে ১০৯ জন, যা মোট নিহতের ২৬.০৮ শতাংশ। এরমধ্যে থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ১০৮ জন নিহত হয়েছে।

অটোরিকশার নগরীতে যানজটে চরম দুর্ভোগ

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি কর্পোরেশন রংপুর। ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বিশাল রংপুর নগরীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব সড়কই এখন ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও চার্জাররিকশার দখলে। নিয়ন্ত্রণহীন এসব বাহনের অবাধ বিচরণে অনেকটাই বেসামাল নগরবাসী। সড়কে বের হলে একাধিকবার পড়তে হয় ট্রাফিক সিগন্যালের মুখে। মহানগরের যত্রতত্র পার্কি, যাত্রী উঠা-নামা ও বৈধ অবৈধ রিকশা স্ট্যান্ডের কারণে জনদুর্ভোগের সঙ্গে বেড়েছে যানজট।

রংপুর বিভাগীয় নগর হওয়ায় প্রতিদিন আশপাশের জেলা থেকে লাখো মানুষের আনাগোনায় দুর্ভোগ বেড়েছে বহুমাত্রায়। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, অবৈধ এসব বাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা।

মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ব্যাটারি চালিত অটো ও চার্জাররিকশায় ঠাসা। যাত্রী দেখলেই চালকরা যেখানে-সেখানে রিকশা অথবা অটোরিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আবার সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীর আশায় অটোরিকশাগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। থেমে থেমে কোথাও অটোরিকশার জটলা তৈরি হয় আবার কোথাও দীর্ঘ সারি হয়ে যায়।

এই দীর্ঘ সারির কারণে পথচারীদের সড়কের একপাশ থেকে অন্যপাশে চলাচল করাও বেশ কষ্টকর। দুর্ঘটনাপ্রবণ ও বিপজ্জনক এসব হালকা যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বাস্তবে চিত্র উল্টো। ট্রাফিক আইন অমান্য করে এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এসব অটো ও চার্জাররিকশা যাত্রীদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

নিবন্ধনহীন লক্ষাধিক অটোরিকশা

রংপুর মহানগরসহ আট জেলা ও উপজেলায় বৈধ-অবৈধ মিলে এক লক্ষাধিক ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা ও চার্জাররিকশা চলাচল করছে। এরমধ্যে শুধু রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই রয়েছে অন্তত ৪০ হাজার। পরিস্থিতি এমন যেন সড়কের ‘রাজা’ নিবন্ধনহীন এসব যানবাহন। অথচ সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স শাখার তথ্য অনুযায়ী, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ৫ হাজার ৩৪১টি এবং চার্জাররিকশা ৫ হাজার ৮০০টি নিবন্ধিত।

একেকটি অটোরিকশার লাইসেন্স পেতে সিটি কর্পোরেশনে জমা দিতে হয় ১৭ হাজার ৭০০ এবং চার্জাররিকশা ও ভ্যানের জন্য ৩ হাজার ৩০০ টাকা। কর্তৃপক্ষের দাবি, কয়েক বছর ধরে সিটি কর্পোরেশন থেকে নতুন করে এসব বাহনের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এখন শুধু নবায়ন করা হচ্ছে। তবে বাইরে অন্য কারও কাছ থেকে একেকটি অটোরিকশার পুরোনো লাইসেন্স হাত-বদলে গুনতে হচ্ছে লক্ষ টাকা।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স শাখার কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মিজু বলেন, অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নতুন করে আর কোনো লাইসেন্স ইস্যু হয়নি। বিগত সময়ের দেওয়া লাইসেন্সই বহাল রয়েছে। এখন শুধু নবায়ন করার সুযোগ রয়েছে। যারা নবায়ন করছে না এবং অবৈধ ও অনিবন্ধিত অটো, রিকশা ও ভ্যান ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এদিকে, ২০০৬-০৭ সালের দিকে একটি প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম চীন থেকে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক আমদানি করে বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

সরকারি সংস্থাটি বলছে, এগুলোর ডিজাইন এবং ফিটনেস পরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় নিবন্ধন ও রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। একটু ঝাঁকুনি লাগলেই উল্টে যায়। তবে পরবর্তীতে আমদানিকারকরা এগুলো আমদানি চালিয়ে যান এবং গ্রামাঞ্চলে বিক্রি শুরু করেন। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের অনুমতি নিয়ে এগুলো স্থানীয়ভাবে চলাচল করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এর সংখ্যা রংপুরসহ সারা দেশে ৪০ লক্ষ ছাড়িয়েছে।

বেড়েছে দাম, কমেছে মান

বর্তমানে বেশিরভাগ ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক. অটোরিকশা ও চার্জাররিকশা দেশেই সংযোজিত হচ্ছে। শুধুমাত্র চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ব্যাটারি, মোটর, কন্ট্রলার, চার্জারসহ বিভিন্ন পার্টস দিয়ে শুধু ফিটিং হয়। ব্যবসায়ী ও চালকরা বলেন, দেড় দশক আগেও ব্যাটারি চালিত যেসব অটোরিকশা ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকায় পাওয়া যেত। এখন তা বেড়ে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।

তবে ব্যাটারি ভেদে দামে কিছুটা হেরফের রয়েছে। আর চার্জাররিকশা এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায়। তবে আগের মতো এখন এসব বাহনের মান নিয়ে নেই সন্তুষ্টি। বরং দেশীয় সংমিশ্রণ আর মানহীন যন্ত্রাংশের সংযোজন এবং ব্যাটারির কারিশমায় অটো ও চার্জাররিকশা ক্রয় করে কেউ কেউ প্রতারিত হচ্ছে।

রংপুর নগরীর আব্দুস সামাদ বলেন, আগের তুলনায় এখন ব্যাটারিসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের দাম অনেক বেশি। এ কারণে আমদানিকারকরা এসব বাহনের দাম বাড়িয়েছে। বর্তমানে ব্যাটারি চালিত একটি চার্জাররিকশা সর্বনিম্ন ৭০ হাজার টাকা। মিশুক রিকশার সিট ক্যাপাসিটি ভেদে একেকটি রিকশার দাম ১ লক্ষ ১৮ হাজার থেকে শুরু করে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা।

এছাড়া ব্যাটারি চালিক বোরাক অটোরিকশা এখন আড়াই লক্ষ থেকে দুই লক্ষ পয়ষট্টি হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ ক্রেতারা কিস্তি সুবিধায় ক্রয় করলে দাম একটু বেশি হয়ে থাকে। রংপুর অঞ্চলে বেকার সমস্যা দূরীকরণে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে তিন চাকার বাহনের। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এর দাম বাড়লেও বাড়েনি ব্যাটারিসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের মান।

যাত্রী ও চালকসহ সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব ব্যাটারির ব্যবহার না থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে যাত্রী পরিবহনে বেড়েছে ভাড়া। সঙ্গে আয়ের জন্য নির্ভরতাও বেড়েছে এসব বাহনের প্রতি। ব্যাটারি চালিত অটো ও চার্জাররিকশা বন্ধ করে দেওয়া হলে অসংখ্য মানুষ কাজ হারাবে।

 রংপুরের মতো জায়গায় অটোরিকশা বেকার যুবসমাজের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এখন সড়ক-মহাসড়কে এর দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এসব যানবাহনের চলাচল বন্ধ না করে নিয়ন্ত্রণে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নিতে হবে। যদি চলাচল বন্ধ করা হয় তা হলে সারা দেশে ছিনতাই, চুরি, রাহাজানিসহ খারাপ কাজ বাড়বে; অটোরিকশার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।

জরিমানা করেও নেই সুফল

রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, অভিযান চালানো হলেও প্রভাবশালী মহলের কারণে অনিবন্ধিত ব্যাটারি চালিত অটো ও চার্জাররিকশা বন্ধ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি যাত্রীদের চাহিদাও এদের টিকিয়ে রাখছে। হাজারো পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস এসব বাহন। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোসহ যানজট নিরসনে নিয়মিত অভিযানে জব্দ ও জরিমানা করা হয়ে থাকে।

বিআরটিএ এর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) শফিকুল আলম সরকার বলেন, যানজট সৃষ্টির মূল কারণ অটোরিকশা। চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। তারা জানে না কীভাবে অটোরিকশা চালাতে হবে। ব্যাটারি চালিত তিন চাকার বাহনগুলো কমপক্ষে শতকরা ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. শরীফুল আলম বলেন, নিয়মিত অভিযান ও জরিমানা করেও অনিবন্ধিত যানবাহনের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। প্রতি মাসেই কম-বেশি অভিযান চলছে। নগরীতে বিকল্প সড়ক ব্যবস্থা না থাকায় যানজটের চাপে আমাদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগও চেষ্টা করছে।

কিন্তু শুধু আইন প্রয়োগ করে তো এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা, সহযোগিতা, সচেতনতা এবং পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হবে।

অটোরিকশায় প্রতিমাসে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ

রংপুরে ব্যাটারি চালিত অটো ও চার্জাররিকশা প্রতিদিন তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করছে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে অটোচার্জে। চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় অটোরিকশা চার্জ অনেকটা মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে বিদ্যু নিয়ে বাড়ছে ভোগান্তি। জানা যায়, পাঁচ ব্যাটারি সংযুক্ত একেকটি  অটোরিকশা চার্জ দিতে প্রতিদিন ১০ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সেই হিসাবে এসব আটো চার্জ দিতে ২৫ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়।

সেই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অটোরিকশা চার্জ দিতে চলে যাচ্ছে। প্রতিমাসে ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার পেছনে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগরীর আশপাশসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক স্পটে ব্যাটারি চালিত চার্জাররকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইকের এসব গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে।

প্রতিটি গ্যারেজে রয়েছে চার্জ দেওয়ার সুবিধা। চার্জে অনেক বিদ্যুৎ লাগে। গ্যারেজগুলোর বিদ্যুতের সংযোগ বৈধ না অবৈধ, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কোনো কোনো এলাকায় আবাসিক লাইন থেকেও চার্জিং পয়েন্টে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়া হয়েছে, যা বিদ্যুৎ আইনের পরিপন্থী। সুষ্ঠু মনিটরিং করলে অবৈধ চার্জ দেওয়া বন্ধ করা সম্ভব।

একটি অটোরিকশা ভাড়া দিন শেষে ৫৫০ টাকা দিতে হয়। চার্জ দেওয়া, রিকশার মেরামত, সবই মালিক দেখেন। ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সব ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্ট বন্ধ করা হবে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগ। নর্দান ইলেক্টিক সাপ্লাই নেসকো রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, একটি অটোরিকশা চার্জে প্রতিদিন ১০ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করছে। বিদ্যুতের একটি অংশ অটোরিকশায় চলে যাচ্ছে।

ব্যাটারির সিসা ধ্বংস হয় না থেকে যায় প্রকৃতিতে

ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির পুনঃচক্রায়ন প্রক্রিয়া এবং পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেই গবেষণার তথ্য বলছে, ব্যাটারি চালিত অটো ও চার্জাররিকশা মানুষের অগোচরে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের অকল্পনীয় সর্বনাশ করে যাচ্ছে। খরচ কম, তাই জনগণ ব্যবহার করছে কিন্তু এর ফলাফল কেউ ভাবছে না।

ব্যাটারিতে ব্যবহৃত সিসা ‘ধ্বংস হয় না’ বরং ‘প্রকৃতিতে থেকে যায়’ এমনটাও বলা হয়েছে গবেষণা থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে। সিসার কারণে মানুষের আইকিউ লেভেল কমে যায়, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সিসা হাইপারটেনশন ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের জন্যও দায়ী।

অটোরিকশাই ভোগান্তির কারণ

যানজট কমাতে হলে অনিবন্ধিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সুশীল সমাজ। সড়কে এসব অটোরিকশার চলাচল নিষিদ্ধ করলে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে। তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকদের মাধ্যমেই এসব বাহন পরিচালনার দাবি জানানো হয়। অটোচালক, শ্রমিক, স্থানীয় ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সংগঠকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের আগেও রংপুরে অটোরিকশার যেমন দাপট ছিল, ৫ আগস্টের পর সেই দাপট ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে।

ট্রাফিক বিভাগের শিথিল নজরদারির সুযোগে এখন নগরীর অলিগলি থেকে প্রধান সড়কগুলোতেও অটোরিকশার নির্বিঘ্ন চলাচল চোখে পড়ছে। যা নগরবাসীর নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিতে ফেলছে। রংপুর জেলা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা মালিক শ্রমিক সমবায় সমিতির এক নেতা বলেন, অবৈধ অটো ও চার্জাররিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে আমরা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন, নিয়মিত অভিযান, জরিমানা ও আলাদা লেন তৈরি করাসহ চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে সিটি কর্পোরেশনকে একাধিকবার অনুরোধ করেছি।

কিন্তু আমাদের প্রস্তাবনার প্রতি কোনো রকম গুরুত্ব হয়নি। সচেতন মহল বলেন, জনপ্রতিনিধিদের অনীহা ও প্রশাসনের ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ নীতির কারণে সড়কে অটো ও চার্জাররিকশার একচেটিয়া রাজত্ব এখনো দৃশ্যমান।
 

BD/AN

শেয়ার করুনঃ
Advertisement