আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ৭১তম বার্ষিকীর তাৎপর্য
Published : ১৩:২০, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সূচনার ৭১তম বার্ষিকী দেশটির ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। এটি শুধু আলজেরিয়ার নয়, বরং ২০শ শতাব্দীর স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক সংগ্রামেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ত্যাগের কথা, যা আলজেরিয়ার জনগণ শতাব্দীব্যাপী ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য করেছে। ১৯৫৪ সালের এই দিনে “ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট” (FLN) ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বড় আক্রমণ শুরু করে, যা আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা ঘটায় এবং ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা অর্জন হয়।
এই বার্ষিকী কেবল ইতিহাসের স্মৃতি নয়, বরং জাতীয় ঐক্য, দৃঢ়তা ও আত্মনির্ভরতার এক উদযাপন। এটি বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তি ও স্থায়িত্বের প্রতীক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বহু উপনিবেশ স্বাধীনতার দাবিতে এগিয়ে আসে, তখন আলজেরিয়ার সংগ্রাম ছিল তাদের অনুপ্রেরণা। তাই এই বার্ষিকী আলজেরিয়ার জনগণকে শুধু অতীতের ত্যাগ স্মরণ করায় না, বরং ন্যায়, ঐক্য ও উন্নত ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করে।
ঔপনিবেশিক আলজেরিয়ার প্রেক্ষাপট
আলজেরিয়ার ঔপনিবেশিক ইতিহাস ছিল সহিংসতা, শোষণ ও বৈষম্যে পরিপূর্ণ। ১৮৩০ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়ায় শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং স্থানীয় জনগণের উপর কঠোর নিপীড়ন চালায়। “পিয়েদ-নোয়ার” নামে পরিচিত ফরাসি উপনিবেশবাদীরা সকল সুবিধা ভোগ করত, আর স্থানীয় আলজেরিয়ানরা বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও অবমাননার শিকার হত। শিক্ষা, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ফরাসি প্রভাব চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা আলজেরিয়ার পরিচয় ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও গভীর করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা
১৯৫৪ সালের ১লা নভেম্বর রাতেই ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। সেদিন FLN দেশজুড়ে ফরাসি সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় একযোগে হামলা চালায়—যা আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করে। প্রায় আট বছরব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ এবং উভয় পক্ষের জন্যই বিধ্বংসী। FLN গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে যুদ্ধ পরিচালনা করে এবং দ্রুত গ্রামীণ জনগণের সমর্থন অর্জন করে। ফরাসি সেনাদের নির্যাতন, গণহত্যা ও নির্বাসনের মধ্যেও আলজেরিয়ার জনগণ দৃঢ়চিত্তে স্বাধীনতার জন্য লড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক সংহতির ভূমিকা
আলজেরিয়ার যুদ্ধ শুধু একটি জাতীয় সংগ্রাম ছিল না; এটি ছিল বৈশ্বিক উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলোর পতন শুরু হয়, তখন আলজেরিয়ার সংগ্রাম হয়ে ওঠে স্বাধীনতার বিশ্বজনীন প্রতীক। আরব বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো FLN-কে সমর্থন দেয়। একই সঙ্গে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে FLN তাদের অবস্থান শক্তিশালী করে তোলে, যার ফলে ফরাসি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৬২ সালে “ইভিয়ান চুক্তি”-র মাধ্যমে আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার
আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দেয়নি, বরং জাতীয় গর্ব ও আত্মপরিচয়ের জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধের সময় এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, তবুও স্বাধীনতার স্পৃহা কখনো নিভে যায়নি। আজও সেই সংগ্রাম আলজেরিয়ার জাতীয় চেতনার মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তবে স্বাধীনতার পরও ঔপনিবেশিকতার প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি—রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক বৈষম্য এখনো জাতির সামনে বড় সমস্যা।
ভবিষ্যতের পথে
৭১তম বার্ষিকী আলজেরিয়ার জন্য শুধু উদযাপনের নয়, বরং আত্মসমালোচনারও সময়। স্বাধীনতার পর দেশটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোয় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিন্তু যুব বেকারত্ব, রাজনৈতিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের মতো চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। আজকের প্রজন্মের জন্য এই বার্ষিকী এক অনুপ্রেরণা—যে ঐক্য, ত্যাগ ও সাহস দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সেই একই মূল্যবোধই ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ আলজেরিয়া গঠনে সহায়ক হবে।
উপসংহার
আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ৭১তম বার্ষিকী জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংযোগস্থল। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার জন্য রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মর্যাদা, এবং শেখায়—ন্যায়, ঐক্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই কখনো শেষ হয় না। আলজেরিয়া আজও সেই চেতনার ধারক, যে চেতনা স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা করেছিল ১৯৫৪ সালের ১লা নভেম্বর রাতে।
বিডি/এএন


































