টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল—আওয়ামী লীগ সরকারের সময় র্যাবের এই বন্দিশালায় ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম করে রাখা ও নির্যাতনের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় ছিল।
সেই গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এই মামলায় মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আসামিদের তালিকায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে ১২ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা একসময় র্যাবের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ গঠনের আদেশকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র বাকবিতণ্ডা দেখা দেয়, যা একপর্যায়ে আদালতের হস্তক্ষেপে থামে।
২৩ ডিসেম্বর গুমের এই মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর কার্যক্রম শুরু হয়। চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চে আরও ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
শুনানির শুরুতেই আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবীর অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা চারটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাঠ করে শোনানো হয় কাঠগড়ায় উপস্থিত ১০ আসামির সামনে। অভিযোগ পাঠ শেষে বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী আসামিদের কাছে জানতে চান, তারা দোষী নাকি নির্দোষ। জবাবে প্রত্যেকেই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এ সময় এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, তারা সবাই নিরপরাধ এবং আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাবেন বলে দৃঢ় আশাবাদী।
সব বক্তব্য শোনার পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে উল্লেখ করে ১৭ জনের বিরুদ্ধেই বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণের সময়সূচিও নির্ধারণ করা হয়। তবে এর আগে প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেন গ্রেপ্তার সাত সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী তাবারক হোসেন।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের দেওয়া বিপুল নথিপত্র পর্যালোচনা করা, সাক্ষীদের বক্তব্য খতিয়ে দেখা এবং ঘটনাস্থল টিএফআই সেল পরিদর্শন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার কথাও জানান তিনি। পর্যাপ্ত সময় না পেলে যথাযথভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করা সম্ভব হবে না বলে আদালতকে অবহিত করেন।
এ সময় বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ মন্তব্য করেন, রিভিউ আবেদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সময় দেওয়ার প্রশ্নটি দেখা যেতে পারে। তার এই বক্তব্যে আপত্তি জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি উচ্চস্বরে বলেন, রিভিউয়ের অজুহাতে কি পুরো বিচারপ্রক্রিয়া থমকে থাকবে?
এই বক্তব্যের জেরে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ চিফ প্রসিকিউটরকে ধৈর্য ধরতে বলেন এবং আদালতের শিষ্টাচার মেনে কথা বলার নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার হস্তক্ষেপ করেন এবং সবাইকে বসতে বলেন।
পরে উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষকে প্রস্তুতির জন্য চার সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেন। সে অনুযায়ী আগামী ২১ জানুয়ারি সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়।
শুনানির দিন সকালে ঢাকার সেনানিবাসের বিশেষ কারাগার থেকে গ্রেপ্তার ১০ জন সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন।
শুনানি শেষে প্রসিকিউটর শাইখ মাহদী সাংবাদিকদের বলেন, চিফ প্রসিকিউটর আইনের বিধান অনুযায়ী অযথা বিলম্ব না করার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আদালতে যেসব কথাবার্তা হয়েছে, তা স্বাভাবিক আইনি তর্কের অংশ এবং এতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী তাবারক হোসেন বলেন, আদালতের অনুমতি নিয়েই তারা কথা বলেন এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের উত্তপ্ত পরিস্থিতি আর না ঘটে, সে বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল সতর্ক করেছেন।


































