২ হাজার বছরের ‘অমরত্বের’ সাক্ষী নেমরুত পাহাড়
Published : ১৯:০৬, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আদিয়ামান প্রদেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রহস্যময় মাউন্ট নেমরুত—একটি পাহাড়, যার চূড়ায় উঠে গেলে মনে হয় যেন ভিন্ন এক যুগে প্রবেশ করা হয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার মিটার উচ্চতার এই পাহাড় দূর থেকে সাধারণ মনে হলেও ওপরে উঠলেই চোখে পড়ে সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাথরের মাথা, যেগুলো যেন আজও নীরবে পাহারা দিচ্ছে রাজা অ্যান্টিওকাস প্রথমের সমাধিকে।
কখনো এই পাহাড়ের ঢালজুড়ে ছিল অসংখ্য অলিভ গাছের বাগান। এখন সেখানে শুধু পাথর, শুকনো ঘাস আর ইতিহাসের গভীর নীরবতা। নিচে ছাগলের চলাচল দেখা গেলেও উপরের বাতাসে আছে এক অদ্ভুত স্থিরতা, যা স্পর্শ করে যায় সহস্র বছরের স্মৃতি।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ইউফ্রেটিস নদীর উত্তরে ছিল ছোট্ট রাজ্য কম্মাজেন। গ্রিক, পারস্য, আসিরীয় ও আর্মেনীয় সংস্কৃতির অনন্য সংমিশ্রণে গড়া সেই রাজ্যের শাসক অ্যান্টিওকাস প্রথম চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরও দেবতাদের সঙ্গে অবস্থান করতে। তাঁর সেই ইচ্ছার প্রতিফলনই দেখা যায় নেমরুতের চূড়ায় নির্মিত সমাধিতে, যার চারপাশে স্থাপন করা হয়েছিল দেবতা ও বীরদের বিশাল মূর্তি এবং তাদের মাঝেই ছিল রাজা নিজস্ব ভাস্কর্য।
সময়ের নিষ্ঠুরতায় অনেক মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাকি থাকা পাথরের মুখগুলো আজও দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে—প্রাচীন ইতিহাসের স্মারক হয়ে। স্থানীয়রা স্থানটিকে ‘দেবতাদের সিংহাসন’ নামে ডাকেন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, এসব ভাস্কর্যের বয়স প্রায় দুই হাজার বছর।
নেমরুত এখন ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় পাহাড়ের চূড়া বিভিন্ন রঙে রূপ বদলায়, আর তখনই সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় পর্যটকদের। আদিয়ামানের কাহতাহ জেলা থেকে গাড়িতে মাত্র ৫০ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যায় পাহাড়ের কাছাকাছি। পথে চোখে পড়ে রোমান যুগের সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস সেতু এবং কম্মাজেন রাজপরিবারের নারীদের স্মৃতিতে নির্মিত কারাকুশ টিউমুলাস।
চূড়ার কাছেই রয়েছে একটি আধুনিক পার্কিং এলাকা ও ভিজিটর সেন্টার। সেখান থেকে প্রায় ২৫ মিনিটের হাঁটায় উঠে যেতে হয় মূল স্থানে—প্রায় ৫০০ মিটার পথ আর ৩০০-এর বেশি সিঁড়ি। উপরে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য হলেও শীর্ষে পৌঁছে দৃশ্য দেখলে সব পরিশ্রম ভুলে যেতে হয়।
চূড়ায় রয়েছে টিউমুলাস নামের এক বিশাল পাথরের ঢিবি, যার উচ্চতা প্রায় ৫০ মিটার। ধারণা করা হয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে অ্যান্টিওকাসের প্রকৃত সমাধি। চারদিকে দেখা যায় দেবতা জিউস, অ্যাপোলো, হারকিউলিস, কম্মাজেনের উর্বরতার দেবী এবং রাজা অ্যান্টিওকাসের মূর্তি—যেগুলোর একসময় উচ্চতা ছিল প্রায় ১৫ মিটার।
১৮৮১ সালে জার্মান প্রকৌশলী কার্ল সেস্টার স্থানটির অস্তিত্ব প্রথম শনাক্ত করেন। তারপর বহু অনুসন্ধান হলেও সমাধির ভেতরের কক্ষ এখনো অধরা রহস্য। অনেক গবেষক মনে করেন, এর কাঠামো মিশরীয় পিরামিডের মতো জটিল।
১৯৮৭ সালের পর আর কোনো খনন হয়নি। স্থানীয় গাইড সালিহ আবুরসুর মতে, খনন না হওয়ার কারণেই সমাধির রহস্য আজও অটুট রয়েছে। এখন পুরো স্থানটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে সংরক্ষিত এবং ভাস্কর্যগুলো রক্ষায় ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক ‘ন্যানো লাইম’ প্রযুক্তি।
চূড়ায় দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে দেখা যায় টরাস পর্বতমালা, দক্ষিণে মেসোপটেমিয়ার বিস্তৃত সমতলভূমি, আর দূরে বাঁক নিয়ে বয়ে যাওয়া ইউফ্রেটিস নদী। সন্ধ্যা নামলে ভাঙা ভাস্কর্যের মাঝে বসে সূর্যাস্ত দেখা যেন সময়ের স্রোত পেরিয়ে অন্য এক যুগে যাত্রা করার অনুভূতি দেয়।
শিকাগো থেকে আসা পর্যটক জুলিয়ান বশম্যান বলছিলেন, ইতিহাসের গভীরতা এবং চূড়ার বিস্তৃত দৃশ্য তাকে অভিভূত করেছে। তাঁর ভাষায়, এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় হাজার বছরের পুরোনো পৃথিবী এখনো বেঁচে আছে।
সূর্যের শেষ রশ্মি লাল থেকে অ্যাম্বারে রূপ বদলে মিলিয়ে গেলে, নেমরুত পাহাড় আবার ডুবে যায় তার চিরাচরিত নীরব প্রহরায়—যেখানে দেবতারা আর রাজা অ্যান্টিওকাস যেন আজও পাহারা দিচ্ছেন এক অনন্ত রহস্যকে।
বিডি/এএন



































