বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেফ এক্সিটের ইতিহাস

Published : ১৭:১৩, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
গত এক সপ্তাহ ধরে রাজনীতির অঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব “সেফ এক্সিট” ইস্যুতে। বিষয়টি আলোচনায় আসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের পর।
সেখানে তিনি দাবি করেন, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং নিজেদের জন্য নিরাপদ প্রস্থানের বা ‘সেফ এক্সিট’-এর পরিকল্পনাও করছেন। তার এই মন্তব্য ছড়িয়ে পড়তেই রাজনৈতিক পরিসরে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক ও বিশ্লেষণের ঢল।
এরপর থেকেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে উপদেষ্টাদের প্রায় সবাইকেই এই প্রসঙ্গে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কেউ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেউ বা সরাসরি নাহিদ ইসলামকে জবাব দিয়েছেন।
এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলম সরাসরি পাল্টা মন্তব্য করে বলেন, “সেফ এক্সিট কোথায় নেবে? পৃথিবীতে একটাই সেফ এক্সিট আছে, সেটা মৃত্যু।” নাহিদের বক্তব্য প্রকাশের অল্প সময় পরই এই মন্তব্য দেন তিনি।
বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাও শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক সভায় বলেন, “সেফ এক্সিট নিয়ে কী বলব ভাই? প্রতিটি উপদেষ্টাই বিদেশি নাগরিক।”
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমি একদম কোনো এক্সিট খুঁজছি না।” একই সঙ্গে তিনি নাহিদ ইসলামের উদ্দেশে বলেন, “যাদের নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের নাম তিনি স্পষ্টভাবে বলা উচিত।”
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আরও দৃঢ় ভাষায় জানান, “আমাদের কারোরই কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই।” নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, “আমাদের মধ্যে কেউই সংকটে নেই, তাই এক্সিটের প্রয়োজনও নেই।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী হেসে বলেন, “ছেলেমেয়ে সবাই দেশে থাকে, আমি একা বিদেশে গিয়ে কী করব?”
অন্যদিকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, “যাদের একাধিক দেশের নাগরিকত্ব, তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে!”
ইতিহাসে সেফ এক্সিটের নজির
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সেফ এক্সিট’ শব্দটি এখন আলোচনায় এলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তত তিনবার এমন ঘটনা ঘটেছে— ১৯৭৫, ২০০৭ ও ২০২৪ সালে।
১৯৭৫: প্রথম সেফ এক্সিট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি না করে দায়মুক্তি দেওয়া হয় ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’-এর মাধ্যমে। পরবর্তীতে তাদের বিদেশে কূটনৈতিক পদেও পাঠানো হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম “সেফ এক্সিট”-এর দৃষ্টান্ত।
২০০৭: এক-এগারোর সময়
এক্সিট শব্দটি রাজনৈতিক অভিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে আসে ২০০৭ সালের এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে শতাধিক রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় বসেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “তারা শেখ হাসিনার কাছেই এক্সিট চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হাসিনা ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই তারা দেশ ছাড়েন।” ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ দেশ ত্যাগ করেন।
২০২৪: সর্বশেষ উদাহরণ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণবিক্ষোভে সহিংসতা ও রক্তপাতের পর সেনা তত্ত্বাবধানে বিশেষ বিমানে তাকে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়। মহিউদ্দিন আহমদের ভাষায়, “তিনি প্রাণে বেঁচেছেন, তাই সেটিই তার সেফ এক্সিট।”
এ ছাড়া ২০০৮ সালে তারেক রহমানের দেশত্যাগ নিয়েও আলোচনা হয়, তবে সেটিকে অনেকেই রাজনৈতিক সমঝোতা বললেও “সেফ এক্সিট” হিসেবে গণ্য করেন না।
কেন দেওয়া হয় সেফ এক্সিট?
বিশ্লেষকদের মতে, যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে সংঘাত বাড়তে পারে, তখন উত্তেজনা প্রশমিত করতে ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে “সেফ এক্সিট” পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এতে উভয় পক্ষই আপাতভাবে লাভবান হয়— একজন নিরাপদে সরে যান, অন্য পক্ষও সংঘাত এড়াতে পারে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “যে চলে গেল সে নিরাপদ, আর যারা যেতে দিল তারাও ঝামেলামুক্ত— এই পারস্পরিক স্বার্থের সমীকরণই হলো সেফ এক্সিট।”
বিডি/এএন