কারা সুদানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার পেছনে জড়িত?

কারা সুদানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার পেছনে জড়িত? ছবি: সংগৃহীত

বিজনেস ডেইলি ডেস্ক

Published : ১৪:৪৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সুদানের আবেই অঞ্চলে ড্রোন হামলায় ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন।

তারা জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা বাহিনী আবেই (ইউনিএসএফএ)-এর সদস্য হিসেবে সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গতকাল শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) এই মর্মান্তিক হামলার ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনার পর সুদানের সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকার একটি বিবৃতি দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, প্যারামিলিটারি বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে।

সুদানের সেনাপ্রধান ও ডি ফ্যাক্টো রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এই হামলাকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, শান্তিরক্ষীদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

আরএসএফ সেই বাহিনী, যাদের বিরুদ্ধে এর আগে এল-ফেশার শহরে ভয়াবহ গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় একদিনেই দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তবে আরএসএফ এই হামলার দায় সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। শনিবার টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা জানায়, শান্তিরক্ষীদের ওপর ড্রোন হামলার অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে সুদানের সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এর ফলেই দেশটিতে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়, যা ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ, মানবিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।

সুদানের সেনাবাহিনীর অভিযোগ, আরএসএফকে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এল-ফেশারে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার পর আরএসএফের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত হয়। যদিও আরব আমিরাত এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

সুদানে গৃহযুদ্ধের পটভূমি
২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের শাসক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিনি ১৯৮৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০১৯ সালে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনী তাকে সরিয়ে দেয়। তবে এতে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ওই বছর একটি সেনা-বেসামরিক যৌথ সরকার গঠিত হলেও ২০২১ সালে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকারকেও উৎখাত করা হয়।

এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি ‘হামেদতি’ নামে পরিচিত। ক্ষমতা দখলের পর দেশ পরিচালনা ও বেসামরিক সরকার গঠন নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র মতানৈক্য দেখা দেয়।

সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব তৈরি হয় আরএসএফের প্রায় এক লাখ সদস্যকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেই বাহিনীর নেতৃত্ব কে দেবেন—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। ক্ষমতা, সম্পদ ও আধিপত্য ছাড়তে না চাওয়ায় দুই পক্ষের বিরোধ দ্রুত সহিংস রূপ নেয়।

টানা উত্তেজনার পর ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। কে প্রথম গুলি ছুড়েছিল, তা আজও নিশ্চিত নয়। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই সংঘাত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আরএসএফ রাজধানী খারতুমের বড় অংশ দখলে নেয়। প্রায় দুই বছর যুদ্ধ চলার পর ২০২৫ সালের মার্চে সেনাবাহিনী আবার খারতুমের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

আরএসএফ কারা
আরএসএফ গঠিত হয় ২০১৩ সালে। এই বাহিনীর অনেক সদস্যই কুখ্যাত জানজাউইদ মিলিশিয়া থেকে এসেছে। দারফুর অঞ্চলে বিদ্রোহ দমনের সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে, বিশেষ করে অ-আরব জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরএসএফ একটি শক্তিশালী আধাসামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়। তারা ইয়েমেন ও লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সংঘাতে অংশ নেয়। আরএসএফ প্রধান দাগালো সুদানের বেশ কয়েকটি স্বর্ণখনির নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব সোনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করা হয় বলে দাবি করেছে সুদানের সেনাবাহিনী।

এছাড়া পশ্চিম লিবিয়ার শক্তিশালী নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারও আরএসএফকে অস্ত্র ও সেনা দিয়ে সহায়তা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এসব অভিযোগ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো অস্বীকার করে আসছে।

২০২৫ সালের জুনের শুরুতে আরএসএফ লিবিয়া ও মিসর সীমান্তবর্তী সুদানের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়, যা তাদের জন্য বড় কৌশলগত সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। পরে অক্টোবরের শেষ দিকে তারা এল-ফাশার দখল করে নেয়। এর ফলে দারফুরের বড় অংশ এবং কোরদোফান অঞ্চলের একাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

এই এলাকাগুলোতে আরএসএফ নিজস্ব বিদ্রোহী প্রশাসন গঠন করেছে। এর মধ্য দিয়ে সুদান কার্যত আবারও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর আগে ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, যেখানে সুদানের অধিকাংশ তেলক্ষেত্র অবস্থিত ছিল।

সূত্র: রেডিও তামাজুজ, বিবিসি

বিডি/এএন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement