‘ডিম থেরাপি’ নামে কি সত্যিই কিছু আছে?

Published : ১৬:৩৪, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
মানুষের জীবনে রোগ, দুঃখ কিংবা দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করার ইতিহাস নতুন নয়—বরং সভ্যতার মতোই প্রাচীন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশের বহু আগেই মানুষ ভরসা রাখত প্রকৃতির উপাদান, ধর্মীয় আচার, তাবিজ-কবচ বা লোকবিশ্বাসের ওপর।
সেই ধারারই একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো রহস্যময় এক প্রথা—‘ডিম থেরাপি’। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই পদ্ধতি কি সত্যিই রোগ সারাতে পারে, নাকি এটি শুধুই মানসিক ভরসার আরেক নাম?
লোকবিশ্বাসে ডিমের ভূমিকা
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ সমাজে এখনো দেখা যায়, কোনো শিশু হঠাৎ অসুস্থ হলে বা ‘দৃষ্টিদোষ’ লেগেছে বলে মনে হলে, কাঁচা ডিম তার মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে পরে সেটি ভেঙে দেখা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শিশুর ওপর থাকা অশুভ শক্তি বা ‘নজর’ ডিমের ভেতরে চলে আসে এবং সে ভালো হয়ে ওঠে।
এই প্রথা কেবল আমাদের সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়। মেক্সিকো, পেরু, কিউবা বা ফিলিপাইনের মতো দেশেও ‘লিম্পিয়া’ নামে পরিচিত আচারটিতে ডিম ব্যবহার করা হয় শরীর ও আত্মার শুদ্ধিকরণের প্রতীক হিসেবে। কেউ কেউ ডিম ভেঙে তার ভেতরের আকার ও রঙ দেখে অনুমান করেন—রোগের কারণ কী, কিংবা দুর্ভাগ্য কোথা থেকে এসেছে।
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ডিম থেরাপি
প্রাচীন সভ্যতাগুলোতেও ডিমকে কেন্দ্র করে নানা বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। মিশরীয়রা মনে করত, ডিম নতুন জীবনের সূচনা ও উর্বরতার প্রতীক। গ্রিক ও রোমানরা ব্যবহার করত অশুভ আত্মা দূর করতে। ইউরোপের মধ্যযুগে এমনকি গির্জার আশীর্বাদের অংশ হিসেবেও ডিম ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে লোকায়ত সংস্কৃতিতে ‘ডিম ঘুরানো’ বা ‘ডিমে নজর কাটা’ এখনো বহু গ্রামে একটি সামাজিক আচার হিসেবে টিকে আছে।
আধুনিক দৃষ্টিতে ডিম ও চিকিৎসা
ডিম নিঃসন্দেহে পুষ্টিগুণে ভরপুর—প্রোটিন, ভিটামিন ও প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের চমৎকার উৎস। সে কারণে আজও খাদ্যতালিকায় ডিম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অনেক সময় ওজন কমানোর জন্য ব্যবহৃত ‘এগ ডায়েট’ বা সৌন্দর্যচর্চায় ডিমের ব্যবহারকে কেউ কেউ আধুনিক অর্থে ‘ডিম থেরাপি’ বলেও অভিহিত করেন।
তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ডিম ঘুরিয়ে অসুখ সারানোর কোনো প্রমাণ নেই। বরং কাঁচা ডিমের সংস্পর্শে আসলে স্যালমোনেলা নামের জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়, যা শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
সংস্কৃতি না কুসংস্কার?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ডিম থেরাপি’কে পুরোপুরি কুসংস্কার বলা ঠিক নয়। এটি একধরনের লোকজ সংস্কৃতি, যা মানুষের মানসিক স্বস্তি ও বিশ্বাসের জায়গায় কাজ করে। অসুস্থ অবস্থায় এই ধরনের আচার অনেক সময় রোগীর মনোবল বাড়াতে সহায়তা করে, যদিও চিকিৎসার বিকল্প নয়।
উপসংহার
বৈজ্ঞানিকভাবে ‘ডিম থেরাপি’-র কোনো কার্যকারিতা প্রমাণিত না হলেও, এটি এখনো টিকে আছে সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের এক প্রতীকে পরিণত হয়ে। প্রকৃত অর্থে এটি চিকিৎসা নয়, কিন্তু মানসিক সান্ত্বনা আর ঐতিহ্যের সংরক্ষক হিসেবে এখনো জীবন্ত একটি লোকজ রীতি—যা মানুষের আশা, বিশ্বাস আর সংস্কৃতির গল্প বলে।
বিডি/এএন