রিজার্ভ বাড়ছে, অথচ উপেক্ষিত রেমিট্যান্সযোদ্ধারা—আসল নায়করা কি কেবল সংখ্যায় বন্দি?

Published : ০০:৫১, ২৭ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফের ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে—নিঃসন্দেহে এটি একটি অর্থনীতিক সাফল্যের বার্তা। সরকারের মুখপাত্রেরা একে একটি 'অর্জন' হিসেবে তুলে ধরছেন, আনন্দের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হচ্ছে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার গল্প। কিন্তু এই অর্জনের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি—প্রবাসী শ্রমিক, যাদের আমরা ‘রেমিট্যান্সযোদ্ধা’ বলে থাকি, তাদের কোথাও কোনো স্বীকৃতি, সম্মান বা মূল্যায়ন দৃশ্যমান নয়। রেমিট্যান্স: সংখ্যার বাইরে একটা জীবনের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম কয়েক মাসেই প্রবাসীরা ৮ বিলিয়নের বেশি ডলার পাঠিয়েছেন। অথচ তাদের জীবন যাপন, অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা ন্যূনতম। তারা কেবল পরিসংখ্যানে, বাজেটের পাতায়, মেগা প্রকল্পের অর্থের উৎস হিসেবে গণ্য—কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে তাদের মর্যাদা কোথায়? প্রবাসে কাটানো প্রতিটি দিনই যুদ্ধ।
কেউ মালয়েশিয়ার নির্মাণ সাইটে, কেউ লিবিয়ার মরুভূমির রাস্তায়, কেউ সৌদি আরবে বাস ধুয়ে, কেউ কাতারে কষ্টে রাত পাড়ি দিচ্ছেন। পরিবার থেকে দূরে থাকা, ভাষা না জানা সমাজে টিকে থাকা, কাগজপত্র জটিলতা, বেতন বকেয়া, এমনকি শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের ঘটনাও কম নয়। তবুও তারা দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—নিয়মিত, নিঃস্বার্থভাবে। রাজনৈতিক স্বীকৃতি নেই, ভোটাধিকার নেই বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় অবিচার হলো, তাদের ভোটাধিকার নেই। তারা দেশ চালায়, দেশের অর্থনীতিকে টেনে রাখে, কিন্তু দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণে কোনো অংশ নিতে পারেন না। অথচ বিশ্বের বহু দেশ, যেমন ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি আফ্রিকার কিছু দেশ পর্যন্ত প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছে। এখানে প্রশ্ন আসে—এটা কি শুধুই প্রশাসনিক ব্যর্থতা? নাকি একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা? কারণ এই শ্রমিকদের রাজনৈতিক শক্তি তৈরি হলে সেটা হয়তো ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে, আর সেই আশঙ্কা থেকেই কি তাদের ভোটাধিকার আটকে রাখা হচ্ছে?
পরিবার ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা: একটি অনুপস্থিত নীতি রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে প্রবাসীদের পরিবার স্বস্তিতে আছে—এমন একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে থাকা এসব পরিবার প্রায়ই সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এমনকি প্রতারণার শিকার হন। প্রশ্ন হলো—এই পরিবারগুলোর জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কি আছে? কোনো স্থায়ী স্বাস্থ্যবীমা? সন্তানদের জন্য সরকারি শিক্ষা বৃত্তি? প্রবাসে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে জরুরি সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ? প্রবাসী পরিবারের জন্য বাসস্থান, খাদ্যনিরাপত্তা, বিনিয়োগ সহায়তা? সরকার মাঝে মাঝে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে কিছু সেবা চালু করে, কিন্তু তা বড় অংশের কাছে পৌঁছায় না বা উপকার হয় সাময়িক। মূল সমস্যা হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সুরক্ষা কাঠামোর অনুপস্থিতি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও পেনশন কোথায়? বাংলাদেশে কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অবসরে গেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, গাড়ি, পেনশন পান। কিন্তু একজন প্রবাসী শ্রমিক—যিনি ২০-৩০ বছর প্রবাসে ঘাম ঝরিয়ে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের বাজেট রক্ষা করেছেন—তাকে দেশে ফিরে পেনশনের প্রশ্নে কেউ জিজ্ঞাসাও করে না। একটি জাতীয় পেনশন স্কিম চালু হয়েছে বটে, কিন্তু সেটি প্রবাসীদের জন্য কতটা সহজপ্রাপ্য বা স্বচ্ছ—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ কোটা বা কর অবকাশ, বিশেষ চিকিৎসা কার্ড, সন্তানদের জন্য কোটা—এই ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কোথাও নেই। স্বীকৃতি ছাড়া উন্নয়ন কতটা অর্থবহ? প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা আসলে জাতীয় কৃতঘ্নতারই প্রতিচ্ছবি।
তাদের নিয়ে ভাষণ, ব্যানার, দিবস—এসব মাঝে মাঝে দেখা যায়, কিন্তু রাষ্ট্রের মূলনীতিতে, বাস্তব বাজেট বরাদ্দে, রাজনৈতিক সদিচ্ছায় তারা অনুপস্থিত। আমরা উন্নয়ন বলছি, কিন্তু সেই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারীকে না জানিয়ে, না চিনে এই উন্নয়ন কতটা টেকসই? উপসংহার: এখনই সময় দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের চেহারা দেখানোর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি যদি সত্যিই শক্তিশালী করতে হয়, তবে তা কেবল মেগা প্রকল্প দিয়ে নয়, মানুষের মর্যাদাকে কেন্দ্র করে করতে হবে। এই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা কেবল ডলার পাঠান না—তারা দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নিদর্শন দেন। সেই ভালোবাসার বিনিময়ে রাষ্ট্রের দিক থেকেও দরকার সম্মান, সুরক্ষা ও অধিকার। এখন সময় সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে প্রশ্ন রাখার— প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আপনি কী করছেন? তারা কী পাচ্ছেন? আর ভবিষ্যতে কী পাবেন? রাষ্ট্র যদি এই প্রশ্নের জবাব না দেয়, তবে উন্নয়ন হবে, কিন্তু তা হবে অমানবিক এক আত্মঘাতী প্রক্রিয়া।
S