প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা এক শতাব্দী পেরিয়ে এলেও এখনো আরেকজন বেগম রোকেয়ার মতো দিকনির্দেশক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করতে পারিনি—এটাই আমাদের বড় ব্যর্থতা।
তার ভাষায়, রোকেয়া যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যে চিন্তা ও আলোর পথ দেখিয়েছেন, সেই নির্দেশনা আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারিনি; কথায় সীমাবদ্ধ থেকেছি, বাস্তবে অগ্রগতি খুবই সামান্য।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ড. ইউনূস বলেন, রোকেয়ার জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান কেবল তাঁকে স্মরণ করার জন্য নয়; বরং আমাদের ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজে বের করার আহ্বানও বয়ে আনে। কেন আমরা ১০০ বছরেও আরেকজন রোকেয়া তৈরি করতে পারিনি? কেন এমন কেউ আসলেন না, যিনি সমাজকে আলো দেখাবেন, সামনে এগোতে স্মরণ করিয়ে দেবেন?
শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, যে মহীয়সী নারীর অবদানের স্মরণে এই আয়োজন, তার আত্মা আজ শান্তি পাবে। কারণ তিনি যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ যেসব নারী রোকেয়া পদক পেলেন, তারা সেই সমাজ গড়ার পথে আমাদেরকে এগিয়ে নিচ্ছেন। জাতি হিসেবে আমরা তাদের উদাহরণ থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারি।
তিনি আরও বলেন, রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী—যে সময় সে স্বপ্ন দেখা প্রায় অসম্ভব ছিল, সেই সময়েই তিনি নারী জাগরণের বিপ্লবী চিন্তা তুলেছিলেন। সমাজের অচলায়তন ভেদ করে নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ধারা বহন করে নেওয়ার মতো মানুষ আর উঠে আসেনি—এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বিষয়ে রোকেয়ার বার্তা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সমাজকে কখনো ভুলে যাননি। তার সাহিত্য, বক্তব্য ও কল্পনাশক্তিতে যে ভবিষ্যৎচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে, তা আজও বিস্ময় জাগায়।
তিনি শত বছর আগেই বলেছিলেন—মেয়ে সন্তানকে এমন শিক্ষা দাও, যাতে সে নিজের অন্ন নিজে উপার্জন করতে পারে। চাকরি খুঁজে বেড়ানোর কথা নয়; বরং নিজের উদ্যোগে জীবন গড়ার দৃঢ়তা তৈরি করাই তার কথা।
ড. ইউনূস বলেন, আজ যারা রোকেয়া পদক পেয়েছেন, তারা কেবল বাংলাদেশেরই নন; তারা বিশ্বমঞ্চে দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছেন। তার মতে, এই সম্মান তাদের পথচলার প্রথম ধাপ মাত্র—তাদের এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আরও অনেক দূর।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে চারজন নারীকে রোকেয়া পদক তুলে দেন সরকারপ্রধান ইউনূস। পদকপ্রাপ্তরা হলেন—নারীশিক্ষা (গবেষণা) শ্রেণিতে রুভানা রাকিব, নারী অধিকার (শ্রম অধিকার) শ্রেণিতে কল্পনা আক্তার, মানবাধিকার শ্রেণিতে নাবিলা ইদ্রিস এবং নারী জাগরণ (ক্রীড়া) শ্রেণিতে ঋতুপর্ণা চাকমা।
প্রতিবছর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এই পদক প্রদান করা হয়। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া এবং ১৯৩২ সালের একই দিনে কলকাতার সোদপুরে তার মৃত্যু হয়।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার কাঠামোয় নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই মহীয়সী নারী আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পণ, ধর্মের অপব্যাখ্যাসহ নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।
মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ ও অবরোধবাসিনীসহ তার বিখ্যাত রচনাগুলোতে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও নারীর বন্দিদশার প্রকট চিত্র তুলে ধরেছেন, যা আজও সমাজ পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।
































