একাধিক বিয়ে নিয়ে যা বলা আছে ইসলামে

Published : ২৩:০৪, ২০ অক্টোবর ২০২৫
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ হলো মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র বন্ধন—যা শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্ক নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব, স্নেহ, সহমর্মিতা এবং সমাজের ভারসাম্যের প্রতীক।
তবে সময়ের পরিক্রমায় ইসলামের এই মহান বিধান নিয়ে বহু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে ‘বহুবিবাহ’ বিষয়টি আজ অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগের শিকার। ইসলামের মূল উদ্দেশ্য ও বর্তমান সমাজে তার প্রয়োগের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক গভীর বিভাজন।
আল্লাহ তাআলা বহুবিবাহের অনুমতি দিয়েছেন কঠোর শর্তসাপেক্ষে, যার মূল ভিত্তি হলো ‘ইনসাফ’ বা ন্যায়বিচার। এই ন্যায়বিচার কেবল আর্থিক ভরণপোষণ বা খরচের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সময়, মনোযোগ, ভালোবাসা, আবাসন ও আচরণে পূর্ণ সমতা বজায় রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত।
কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচারের শর্ত
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন—
“আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, এতিমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে তোমাদের জন্য অনুমতি রয়েছে অন্য নারীদের মধ্য থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিবাহ করার। তবে যদি ভয় কর যে ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনই যথেষ্ট।” (সুরা নিসা: ৩)
অন্যদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে বলেছেন—
“যে ব্যক্তি দুই স্ত্রী থাকা অবস্থায় তাদের একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, কেয়ামতের দিন সে অর্ধাঙ্গ ঝুলন্ত অবস্থায় হাজির হবে।” (সুনান আবু দাউদ: ২১৩৩)
আল্লাহ আরও বলেন—
“তোমরা কখনও স্ত্রীদের মধ্যে সম্পূর্ণ সুবিচার করতে পারবে না, যদিও তোমরা তা কামনা কর।” (সুরা নিসা: ১২৯)
অর্থাৎ ভালোবাসা ও মানসিক টানটানির জায়গায় সমতা রাখা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ইসলাম স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—যদি সামান্যতম আশঙ্কা থাকে যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, তাহলে একজন স্ত্রীই যথেষ্ট ও উত্তম।
ইসলামে চার বিয়ের অনুমতি: প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
ইসলাম বহুবিবাহকে বাধ্যতামূলক বা উৎসাহিত করেনি; বরং একে ‘মুবাহ’, অর্থাৎ পরিস্থিতিভিত্তিক একটি অনুমোদিত বিকল্প হিসেবে রেখেছে।
মুফতি তাকি উসমানি বলেন—
“বহুবিবাহ ইসলামে কোনো কর্তব্য নয়, বরং প্রয়োজনভিত্তিক একটি বিকল্প। তবে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি সমাজের ভারসাম্য ও মানবিক সমাধানের অন্যতম পথ হতে পারে।” (ফিকহুল বুয়ু, ১/৪২১)
ইমাম আবুল লাইস সামারকন্দি (রহ.) বলেন—
“যখন সমাজে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি হয় বা বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন বহু বিবাহ একটি শরয়ি ও সামাজিক সমাধান হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।” (তানবিহুল গাফিলিন, পৃ. ৩৪৮)
বাস্তব প্রয়োগ ও উপকারিতা
১. নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা: বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা বা আর্থিকভাবে অসহায় নারীদের জন্য এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ আশ্রয় হতে পারে।
২. প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা: অনেক সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাত অসমান। সেখানে বহুবিবাহ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
৩. ইনসাফের কঠোর শর্ত: ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, তবে তার সঙ্গে ন্যায়বিচারের শর্ত যুক্ত করে দিয়েছে, যা বাস্তবে পালন করা সহজ নয়।
৪. একক বিয়েকে উৎসাহ: নবী (সা.)-এর সাহাবিদের অধিকাংশই এক স্ত্রীতে সন্তুষ্ট ছিলেন। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন—
“যার ইনসাফ নিয়ে সন্দেহ আছে, তার জন্য একটিই শ্রেয়।” (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ২/২৩)
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সীমারেখা নির্ধারণ
ইসলাম-পূর্ব যুগে একাধিক বিবাহের কোনো সীমা ছিল না—দশজন, এমনকি বিশজন স্ত্রীও রাখা হতো। ইসলাম এসে এ বিশৃঙ্খলা দূর করে সর্বোচ্চ চারজন নির্ধারণ করে দেয়। কায়েস ইবনে হারেস (রা.) বলেন—
“আমি ইসলাম গ্রহণের সময় আটজন স্ত্রীর স্বামী ছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘চারজন রাখো, বাকিদের তালাক দাও।’” (ইবনে মাজাহ: ১৯৫৩)
সুরা নিসার ৩ নং আয়াত নাজিল হয় এক এতিম নারীর প্রতি অন্যায় আচরণের প্রেক্ষিতে—যাতে সমাজে দুর্বল নারীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়। (সহিহ বুখারি: ৫০৯২)
আধুনিক বাস্তবতায় অপপ্রয়োগের প্রবণতা
দুঃখজনকভাবে, বর্তমান সমাজে অনেকেই ইসলামি নির্দেশনার প্রকৃত উদ্দেশ্য না বুঝে ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসেবে বহুবিবাহকে ব্যবহার করছেন। প্রথম স্ত্রীর প্রতি ইনসাফ, মানসিক সহমর্মিতা ও সম্মতি উপেক্ষা করে বেপরোয়াভাবে বিয়ে করছেন, যা ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“যে অন্যের ক্ষতি করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (মুসনাদ আহমাদ: ২২৯৭)
উপসংহার: অনুমতি নয়, দায়িত্ব
শরিয়তে অনুমতি পাওয়া মানেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি নয়। বরং এটি একটি বড় আমানত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“দ্বীন হলো কল্যাণকামিতা ও সদুপদেশ।” (সহিহ মুসলিম: ৫৫)
অতএব, ইসলাম যে অনুমতি দিয়েছে, তা দায়িত্বশীলভাবে প্রয়োগ করাই প্রকৃত ঈমানদারের কাজ।
মুফতি মাহমুদুল হাসান গাঙ্গুহি (রহ.) সুন্দরভাবে বলেছেন—
“একাধিক বিবাহের অনুমতি থাকলেও, কেবল সে-ই করুক যার মাঝে চরিত্রের দৃঢ়তা ও ইনসাফের বাস্তবতা আছে।” (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: ৫/১৩৫)
অবশেষে বলা যায়, ইসলাম বহুবিবাহকে বৈধ করেছে, কিন্তু অপব্যবহারকে নয়। ন্যায়, দায়িত্ব ও সহানুভূতির ওপর ভিত্তি করে বিবাহই সমাজে শান্তি ও ভারসাম্য আনতে পারে—অন্যথায় তা হয়ে উঠতে পারে অন্যায়ের অন্যতম উৎস।
বিডি/এএন