বাজারে এলো হাড়িভাঙা আম, ১৫০ কোটি টাকার লাভের স্বপ্ন

Published : ২৩:৫৮, ১৩ জুন ২০২৫
আম পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। এর মধ্যে হাড়িভাঙ্গা আম তো সবার পছন্দের শীর্ষে রয়েছে। আমের নাম শুনলেই সবাই বলে, হাড়িভাঙ্গা আছে? হাড়িভাঙ্গা আম দেশের সীমানা পেরিয়ে অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বাজারে আসা শুরু করলেও আর কদিন পরই হবে হাঁড়িভাঙা আমের ভরা মৌসুম। হাজারো আমচাষি এখন ব্যস্ত হাঁড়িভাঙা আম নিয়ে।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোঁড়াগাছ, ময়েনপুর, চ্যাংমারী, বালুয়া মাসুমপুর; বদরগঞ্জের কুতুবপুর, গোপালপুর, লোহানীপাড়া, রামনাথপুর, কালুপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়েছে প্রচুর। এসব এলাকা যেন এখন হাঁড়িভাঙা আমের রাজ্য।
আমবাগানের মালিক, আমের ফড়িয়া, আমবাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তি, মৌসুমি আম বিক্রেতা, অনলাইনে আম বিক্রেতা, পরিবহন ব্যবসায়ী, কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ী সবাই যে যার মতো করে আম কেনাবেচার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রংপুরের দর্শনা রোড হয়ে পালিচড়া পার হয়ে পারকারহাটের দিকে এগোলে চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি হাঁড়িভাঙা আমবাগান।
গাছে থোকায় থোকায় আম। বাড়ির ভেতরে, উঠানে, রাস্তায় সবখানে হাঁড়িভাঙা আমগাছ। অধিকাংশ চাষি অপেক্ষা করছেন আম পরিপক্ক হতে কৃষি বিভাগের বেঁধে দেওয়া সময়ের জন্য।
তবে কেউ কেউ আম পাড়া শুরু করেছেন। অতিরিক্ত গরমে এ বছর নির্ধারিত সময়ের আগে আম পাকা শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে হাঁড়িভাঙা বাজারে আসার তারিখ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। এ বছর এমন উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ ১৫ জুনের পর পরিপক্ক আম বাজারজাত করতে আমবাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিচ্ছে।
মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন বলেন, আগের বছরগুলোতে ১৫-২০ জুনের মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আনার তারিখ দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসেবে, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ১৫ জুনের পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় হাঁড়িভাঙা আম চাষ করা জমির পরিমাণ ১৯১৫ হেক্টর। এর মধ্যে মিঠাপুকুরে ১২৬৮। জেলায় সম্ভাব্য হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিকটন।
আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গড়ে ৫০ টাকা কেজি ধরলেও হাঁড়িভাঙা আমকে কেন্দ্র করে রংপুরে চলতি মৌসুমে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন হবে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের মাধ্যমে রংপুরের কৃষি অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। এ বছর আমগাছে মুকুল কম এলেও আমের আকার ভালো হয়েছে। তবে অতিরিক্ত গরমের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা বাজারে এসেছে। আমের চাহিদা ও জোগানের ওপর আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের লাভ-লোকসান বোঝা যাবে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন শুরু হওয়ায় কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। কয়েকজন আমচাষি বলেন, গাছ থেকে আম সংগ্রহের ৮-১০ আগেরও অনেকে ছত্রাকনাশক কীটনাশক স্প্রে করেন।
খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, আমবাগানে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ, প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী করা হচ্ছে। বিষমুক্ত আম উৎপাদনে উত্তম কৃষিচর্চা নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। আম সংগ্রহের অন্তত ২০-২৪ দিন আগে থেকে কোনো কীটনাশক ব্যবহার না করতে চাষিদের বলা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার কারণে কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। মিঠাপুকুরের খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জ হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র।
দেশের বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন মৌসুম শুরুর ৫-৭ দিন আগে। তারা ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকে। পদাগঞ্জ বাজারে আমের আকার ও মানভেদে ১৫০০-২৫০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজলা থেকে আম ক্রয় করতে এসেছেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি ২০০ কেজি আম ক্রয় করে বাসে করে সিলেটে পাঠাবেন।
পদাগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের মৌসুমে পদাগঞ্জ থেকে ৫/৬টি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সারাদেশে ভোক্তা পর্যায়ে আম পৌঁছে দেয়।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী রূপক ইসলাম বলেন, গত মৌসুমে শুধু সুন্দরবন কুরিয়ারে পদাগঞ্জ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার হাঁড়িভাঙা সরবরাহ করেছেন তারা। খোঁড়াগাছ মন্ডলপাড়া হয়ে পদাগঞ্জের দিকে যেতে কয়েকটি বাগানে আম সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
হুমায়রা বেগম নামে এক নারী বলেন, ছেলে মোনতিজিল আলম আমের ব্যবসা করেন। তাদের নিজের ও ভাড়া আমবাগান মিলে ৫০০-৬০০ আমগাছ আছে। ভরা মৌসুমে ছোট বাগানের আম সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। আগে থেকে আম বিক্রি করছেন।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের রুবেল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত গরমে আম পাকতে শুরু করেছে। এ জন্য বিক্রি করছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকেরা বলেন, আম বাজারজাতকরণ নিয়ে বেশি সমস্যা হয় পদাগঞ্জ বাজারে। পদাগঞ্জ হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট ব্যবসায়ী আমবাগানের মালিকদের কাছ থেকে আম ক্রয় করে পদাগঞ্জে বিক্রি করতে আসেন। কিন্তু হাটে সামান্য বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। বাজারে শেড নেই। কাদা-পানিতে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। ট্রাক, পিকআপ চলাচলের রাস্তা সরু, খানাখন্দে ভরা। এতে আম ক্রয় করতে এসে পরিবহন নিয়ে ভোগান্তিতে পড়ে ব্যবসায়ীরা।
আম ব্যবসায়ী মানিক মিয়া বলেন, প্রতিবছর জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রাস্তাঘাট ভাঙা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। তবে এ বছর রাস্তা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
মিঠাপুকুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মুলতামিস বিল্লাহ (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে) বলেন, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন।
মিঠাপুকুরের দু’জন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, হাঁড়িভাঙা আম খেতে সুস্বাদু। একেকটি আম ৩০০-৫০০ গ্রাম হয়। কিন্তু এই আম গাছ থেকে সংগ্রহের ৪/৫ দিনের মধ্যে পেকে যায়। এ কারণে প্রতি মৌসুমে প্রচুর আম নষ্ট হয়।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত হিমাগারের দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছরের ২১ জুন মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জে এসে জিআই পণ্য হাঁড়িভাঙা আম মেলা ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে বিশেষায়িত হিমাগারের ঘোষণা দেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ। মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মো. মুলতামিস বিল্লাহ ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন হিমাগার স্থাপনের সরকারের কোনো উদ্যোগের কথা জানাতে পারেননি।
হাঁড়িভাঙা আমের নাম আগে ছিল মালদিয়া। হাঁড়িভাঙা নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিঠাপুকুর উপজেলার খোঁড়াগাছের তেকানী গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকারের নাম। তিনি ছিলেন এক বৃক্ষপ্রেমিক।
নফল উদ্দিনের ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকার বলেন, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল। মিঠাপুকুরের উঁচা বালুয়া গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেখান থেকে একটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তাঁর বাবা। আমগাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে
পানি দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে।
আমজাদ হোসেন বলেন, গাছটিতে একসময় প্রচুর পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চান। তখন তাঁর বাবা মানুষকে বলেন হাঁড়িভাঙা গাছের আম এগুলো। তখন থেকেই গাছটির আম হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়।
শুধু তা-ই নয়, এটি পরিণত হয়েছে রংপুরের ব্র্যান্ডে। পেয়েছে জিআই পণ্যের স্বীকৃতিও। নফল উদ্দিনের বাড়ির হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটি এখনো বেঁচে আছে।
বিডি/ও