মোবারকগঞ্জ চিনিকলে প্রতি কেজি চিনিতে লােকসান ৪১৭ টাকা

Published : ১৬:৫০, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
এক কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ৫৪২ টাকা। বিক্রি করা হয় ১২৫ টাকায়। এ হিসাবে প্রতি কেজিতে লোকসান ৪১৭ টাকা। এভাবে গত ২০২৪ সালের মাড়াই মৌসুমে লোকসান হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর এভাবে বড় অঙ্কের লোকসান দিয়ে চলছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অবস্থিত দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল। ২০২৩ সালের মাড়াই মৌসুমে লোকসান হয় ৩৪ কোটি টাকা। ব্যাংকে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার দেনা মাথায় নিয়ে মিলটি জর্জরিত।
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি বছরের পর বছর পুঞ্জীভূত লোকসান, উচ্চ পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে সামান্য আয় এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধের কারণে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের পেছনে এত বড় অঙ্কের ব্যয় হয়। অন্যদিকে বাজারে বেসরকারি খাতের চিনির দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিক্রির দর ঠিক করতে হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় ও আয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হচ্ছে।
মিল সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৫৮তম আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়েছিল। এ মাড়াই মৌসুমে মিলটি দুই হাজার ৫০০ টনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চিনি উৎপাদন করে এক হাজার ৮৭১ টন। মোট ৭০ কোটি টাকা লোকসানের মধ্যে পরিচালন খাতে হয়েছে ৩৪ কোটি। ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ খরচ হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা, যার বিপরীতে কোনো আয় নেই। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ লোকসানের পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং লুটপাট। মিলের কারখানা, পরিবহন মেরামত ও ক্রয়-বিক্রয়সহ সব জায়গায় অনিয়ম হয়ে আসছে। বেতন-ভাতা ও ওভার টাইম খাতও অনিয়ম হচ্ছে।
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আ ন ম জোবায়ের বলেন, মিলের প্রধান কাঁচামাল উৎপাদনকারী আখচাষিদের আখের মূল্য বৃদ্ধি করতে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে আবেদন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চিনিকলটি লোকসানের কবল থেকে রক্ষা ও লাভজনক পর্ষায়ে নিয়ে যেতে নানা সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
১৯৬৫ সালে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে কালীগঞ্জ শহরসংলগ্ন ২০৮ একর জমির ওপর মোবারকগঞ্জ চিনিকল স্থাপিত হয়। মিলের ২১ একর জমিতে কারখানা, ১০৭ একরে ইক্ষু খামার, ৩৮ একর জায়গায় কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের আবাসিক কলোনি, ১৮ একরে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র এবং ২৪ একর জমিতে পুকুর রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে মিলটি উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে চিনিকলটিতে এক হাজার ১৮৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ৬৫৮ জন। দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষ জনবল সংকটে ভুগছে মিলটি। আর বরাবরই কাঁচামাল হিসেবে আখের সংকট তো আছেই। প্রতি বছর মিলটি ছয় মাস চালু থাকার কথা থাকলেও মাত্র দুই বা আড়াই মাস উৎপাদন কার্যক্রম চলে। শ্রমিকদের ১২ মাসের বেতন-ভাতা দিতে হয়।
মিল ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের ভাষ্য, ব্রিটিশ আমলে মিলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আধুনিকায়নের মুখ দেখেনি। পুরোনো আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন করার কারণে প্রতি বছরই জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়ছে। এ ছাড়া সরকারের ভ্যাট এবং ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। এসব কারণেই মিলটি লোকসানে রয়েছে।
মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার জানান, এক সময় এ অঞ্চলে অনেক চাষিই আখ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এটি এক বছর মেয়াদি আবাদ। বর্তমানে খণ্ডকালীন অনেক ফসলের আবাদ হওয়ায় অনেক চাষিই সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ কারণে কাঁচামাল সংকট দীর্ঘদিনের। এর বাইরে লোকসানের পেছনে অন্যান্য কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি ও মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শফিকুর রহমান রিঙ্কু বলেন, ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে চালিত মিলটি প্রায়ই বন্ধ হয়ে পড়ে। মিলটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম ও মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের আখচাষি আজগার আলী জানান, বর্তমানে অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখের মূল্য একেবারেই কম। মিলটি আখের মূল্য নির্ধারণ করেছে মাত্র ছয় টাকা কেজি। তাই বেশির ভাগ কৃষকের আখ চাষে অনীহা রয়েছে।
BD/AN