আমরা সাধারণত গাছপালাকে নিঃশব্দ, স্থির ও অনুভূতিহীন জীব হিসেবে দেখি। কিন্তু সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিচ্ছে।
এখন জানা গেছে, গাছপালা কেবল জীবন্তই নয়, তারা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত। তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বার্তা আদান–প্রদান করে এবং কখনো কখনো একে অপরকে রক্ষা করেও থাকে।
এই বিস্ময়কর যোগাযোগব্যবস্থা ঘটে আমাদের চোখের আড়ালে, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক বিশাল জৈব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, যেটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন “উড ওয়াইড ওয়েব” (Wood Wide Web)।
গাছের এই যোগাযোগের রহস্যের কেন্দ্রে রয়েছে এক বিশেষ প্রজাতির ছত্রাক, মাইকোরাইজাল ফাঙ্গাস (Mycorrhizal Fungi)। এই ছত্রাক গাছের শেকড়ের সঙ্গে সহাবস্থানে থেকে মাটির নিচে মাইসেলিয়াম (Mycelium) নামের সুতার মতো গঠন তৈরি করে। এই মাইসেলিয়াম আসলে এক জটিল জৈব নেটওয়ার্ক, যা পুরো বনজুড়ে শত শত, এমনকি হাজার হাজার গাছকে একত্রে যুক্ত করে রাখে।
এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছপালা একে অপরের সঙ্গে কার্বন, পানি, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ভাগাভাগি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বড় ও প্রাচীন গাছ, যাকে গবেষকরা “মাদার ট্রি” (Mother Tree) বলে আখ্যা দেন, তার অতিরিক্ত কার্বন ছোট চারাগাছদের কাছে পাঠাতে পারে—বিশেষ করে তারা যারা পর্যাপ্ত সূর্যালোক না পাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ে। এভাবে বনজীবন একে অপরের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে।
আরও বিস্ময়কর হলো—এই নেটওয়ার্ক কেবল পুষ্টি আদান–প্রদানের জন্যই নয়, বিপদের সংকেত পাঠানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়। যখন কোনো গাছ পোকামাকড়ের আক্রমণ বা রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সেটি মাইকোরাইজাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আশেপাশের সুস্থ গাছগুলোকে সতর্কবার্তা পাঠায়। ফলে অন্য গাছগুলো আগেভাগেই তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করে নেয়, যেন এক বনজ সম্প্রদায় যৌথভাবে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে।
এই চমকপ্রদ গবেষণার পথিকৃৎদের একজন হলেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ সুজান সিমার্ড (Suzanne Simard)। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ডগলাস ফার এবং বার্চ, দুটি ভিন্ন প্রজাতির গাছও এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরস্পরকে কার্বন ও পুষ্টি সরবরাহ করে সহযোগিতা করে। তার এই আবিষ্কার আমাদের বনভূমি সম্পর্কে ধারণাকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। বন এখন আর শুধু গাছের সমষ্টি নয়; এটি এক জটিল, আন্তঃসংযুক্ত ও সহানুভূতিশীল জীবসমাজ।
এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি নিউজ, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, এবং স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, যেখানে গাছের এই গোপন যোগাযোগব্যবস্থার বিস্ময়কর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া সুজান সিমার্ডের একটি জনপ্রিয় টেড টক (TED Talk) রয়েছে, যেখানে তিনি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, গাছেরা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে, সতর্কতা দেয় এবং ভালোবাসা ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকে।
এই গবেষণাগুলো আমাদের শেখায়,প্রকৃতি কখনোই নিঃশব্দ নয়; বরং প্রতিটি পাতার, প্রতিটি শিকড়ের ভেতরেই চলছে এক অবিরাম সংলাপ, যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রকৃত সুর তৈরি করে।