জুলাই শহীদদের আত্মত্যাগই হবে আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা: প্রধান উপদেষ্টা

Published : ০০:৪৪, ৬ আগস্ট ২০২৫
জুলাই আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। জুলাই শহিদদের আত্মত্যাগই আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, জুলাই শহিদদের আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেতে দেব না। তাদের আত্মত্যাগই হবে আমাদের পথচলার প্রেরণা, তাদের স্বপ্নই হবে আমাদের আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা। আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের শপথ।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে দেশজুড়ে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, আজ আমরা পুরো জাতি একসঙ্গে স্মরণ করছি এমন এক দিনকে, যা এ দেশের ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে। ৫ আগস্ট শুধু একটি বিশেষ দিবস নয়—এটি একটি প্রতিজ্ঞা, গণজাগরণের উপাখ্যান এবং ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে জাতির পুনর্জন্মের দিন।
এ সময় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।
তবে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও এ দেশের মানুষ সুবিচার ও গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বৈষম্যের শিকার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের উত্তাল জুলাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সংকটময় অধ্যায়—১৬ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ দেশের বিপুল সংখ্যক তরুণ ১৬ বছর ধরে ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। ভালো ফল করেও তারা চাকরির জন্য ক্ষমতাসীনদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। চাকরি ঘিরে তৈরি হয়েছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর তদবিরের বাণিজ্য। যে তরুণ ঘুষ দিতে পারেনি, এলাকার মাফিয়াদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারেনি, সে চাকরি পায়নি।
সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি ছিল মূলত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আরেকটি হাতিয়ার। এর বিরুদ্ধে তরুণ সমাজ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করলেও ফ্যাসিবাদী শাসকের টনক নড়েনি। এই দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিটি সেক্টরে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিল, যারা আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলবে ও কাজ করবে। স্বৈরাচারের পক্ষের সঙ্গী হলেই চাকরি মিলবে, কাজ পাওয়া যাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এমনকি বিচার ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এই ধরনের সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। এ দেশের গরিব মেহনতি মানুষের পয়সা লুট করে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তাদের সহযোগীরা একেকজন টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিল। সীমাহীন দুর্নীতির কবলে পড়ে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
ড. ইউনূস বলেন, এই দেড় যুগে প্রতিটি ন্যায্য দাবি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গত ১৬ বছরে যারা সরকারের সমালোচনা করেছে বা নাগরিক অধিকারের পক্ষে কথা বলেছে, তাদের গ্রেপ্তার কিংবা গুম করা হয়েছে। লাখ লাখ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে নির্বিচারে আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশের ছাত্রসমাজ, তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষ সবাই একত্রিত হয় এক নতুন দিনের প্রত্যাশায়। সমস্বরে তারা বলে ওঠে—এবার ফ্যাসিবাদকে যেতে হবে।
তিনি বলেন, তবুও দেশের মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা চালায় ফ্যাসিবাদী সরকার। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে হত্যাকাণ্ডের তথ্য গোপন করতে চেয়েছে, রাতের অন্ধকারে এলাকায় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন আহতদের ভর্তি না করা হয়। এর ফলে বহু মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, পঙ্গু হয়ে গেছে।
ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে’ আমি জাতির সূর্যসন্তান—জুলাই শহিদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। যারা আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, দৃষ্টি হারিয়েছেন—জাতির পক্ষ থেকে আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই জাতি আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
তিনি বলেন, আজ আমরা কেবল অতীত স্মরণ করতে আসিনি—আমরা একটি শপথ নিতে এসেছি। শপথ এই যে—আমরা কোনো ধরনের নিপীড়নের কাছে মাথা নোয়াব না। আমরা প্রতিষ্ঠা করব একটি জবাবদিহিমূলক, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র—একটি রাষ্ট্র, যা সবসময় জনকল্যাণে কাজ করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছর ডিসেম্বর মাসে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে’ শহিদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণ ও যাবতীয় বিষয়াদির প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত ৮৩৬টি শহিদ পরিবারের মধ্যে ৭৭৫টি পরিবারকে মোট ৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা বাবদ ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট পরিবারের কয়েকটি বিষয় নিষ্পত্তির পর তাদেরও সঞ্চয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এ ছাড়া আহত ১৩ হাজার ৮০০ জন ‘জুলাই যোদ্ধাকে’ তিনটি ক্যাটাগরিতে নগদ অর্থ ও চেক বাবদ মোট ১৫৩ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ জন অতি গুরুতর আহত ‘জুলাই যোদ্ধাকে’ উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাবদ এ পর্যন্ত ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সরকার নির্ধারিত বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সব শ্রেণির আহত ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ‘জুলাই শহিদ’ ও আহতদের জন্য আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
তবে জুলাইয়ের মহানায়কদের আত্মত্যাগ তখনই সার্থক হবে—যখন এই দেশকে আমরা একটি সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।