যা আছে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায়

Published : ১৯:১৮, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল ৫টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এক আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক এই সনদে স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়।
এ সনদে সাতটি মৌলিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। যা, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে থাকবে।
অঙ্গীকারনামার মূল বিষয়বস্তু
ঢাকা পোস্টের হাতে পাওয়া জুলাই সনদ ২০২৫-এর অঙ্গীকারনামার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, “গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া”—এটাই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান নীতি।
প্রথম অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে দীর্ঘ সংগ্রাম ২০০৯ সাল থেকে চলেছে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরিণতি। এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেই ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সুযোগে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
দ্বিতীয় অঙ্গীকারে ঘোষণা করা হয়, যেহেতু জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, তাদের অভিপ্রায়ই হবে সর্বোচ্চ আইন। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এই সনদ গ্রহণ করেছে। তাই সনদটি সংবিধানে তফসিল আকারে সংযোজন বা উপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।
তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বরং এর প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
চতুর্থ দফায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য জনগণের ১৬ বছরের সংগ্রাম—বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
সবচেয়ে আলোচিত পঞ্চম দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার করা হবে। শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, শহীদ পরিবারকে সহায়তা, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
আজকের স্বাক্ষরের আগে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ দাবির মুখে এই দফাটি সংশোধন করা হয়। নতুন ভাষ্য অনুযায়ী, আহত জুলাই বীরদের “রাষ্ট্রীয় বীর” হিসেবে স্বীকৃতি, মাসিক ভাতা, চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং আইনগত দায়মুক্তি ও নিরাপত্তা সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ দফায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ কাঠামো ও দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্যাপক সংস্কারের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এসব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি সংশোধন বা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে।
সপ্তম ও শেষ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর করবে—কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই।
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর ভিত্তি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তখন হাজারো ছাত্র, তরুণ ও সাধারণ নাগরিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দমননীতি, রাজনৈতিক নিপীড়ন, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। সেই আন্দোলনে সহস্রাধিক মানুষ শহীদ হন, প্রায় ২০ হাজার আহত বা পঙ্গুত্ববরণ করেন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন।
এই পটভূমিতেই জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ আজ নতুন বাংলাদেশের পথনির্দেশক নথি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল।
বিডি/এএন