গহনা ছেড়ে কোরআন লেখায় বিশ্বরেকর্ড গড়লেন আলি জামান

গহনা ছেড়ে কোরআন লেখায় বিশ্বরেকর্ড গড়লেন আলি জামান ছবি: সংগৃহীত

বিজনেস ডেইলি ডেস্ক

Published : ১৪:২৩, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

গহনা কারিগর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও ছোটবেলা থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি আলি জামানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সেই নেশার তাগিদে তিনি একসময় পেশা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান।

সেখানে পেট চালানোর পাশাপাশি ক্যালিগ্রাফি নিয়ে তার সংগ্রাম ছিল দীর্ঘ ও কঠিন। কিন্তু এই অধ্যবসায় তাকে এনে দিয়েছে এক অনন্য স্বীকৃতি, এবং তার নাম ঠাঁই পেয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের পাতায়।

ইরাকি ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আলি জামান ১৯৭১ সালে ইরাকের সুলায়মানিয়ার রানিয়ে জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ক্যালিগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি গহনা কারিগর হিসেবে কাজ ছেড়ে পুরোপুরি ক্যালিগ্রাফিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

ক্যালিগ্রাফির নেশা এতটাই প্রবল ছিল যে ২০১৭ সালে তিনি পরিবারসহ ইরাক ত্যাগ করে তুরস্কে চলে আসেন। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় বসবাস শুরু করে তিনি ক্যালিগ্রাফির উপর মনোনিবেশ করেন। ছয় বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর আলি জামান হাতে লিখে ফেলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরআনের কপি। এই কোরআনের প্রতিটি পাতা ৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১.৫ মিটার প্রস্থের, যা ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে।

এর আগে আলি জামান ৩০ পৃষ্ঠার একটি কোরআন প্রকল্প শেষ করেছিলেন, যেখানে প্রতিটি পাতা ছিল ২.১০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১.৫০ মিটার প্রস্থের। এরপর তিনি আরও বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। এক বছর ধরে গবেষণা, মাপ নির্ধারণ এবং উপকরণ সংগ্রহের পর ২০২০ সালে তিনি তার শিক্ষক বিজার এরবিলিকে ডিজাইন দেখান এবং অনুমোদন পান।

জামানের লেখা নতুন কোরআনটি থুলুৎ লিপি ব্যবহার করে হাতে লেখা হয়েছে এবং কোনো আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। খোলা অবস্থায় প্রতিটি পাতার আয়তন ৩ মিটার বিস্তৃত। ছয় বছর ধরে তিনি প্রতিদিন সকালবেলায় নামাজের পর কাজ শুরু করতেন। খাবার ও নামাজের সময় বাদে কোনো বিরতি নিতেন না। প্রতিটি অক্ষর নিখুঁতভাবে লিখতেন এবং আয়াতগুলো লাইন বাই লাইন হস্তলিখন করতেন।

তবে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে তার স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে অসুস্থতার কারণে কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হয়। শরীরের ওজন ৮৩ কেজি থেকে কমে ৫৮ কেজি হয়ে যায়। তারপরও কোনো বাহ্যিক সাহায্য ছাড়াই তিনি প্রকল্প সম্পন্ন করেন।

আন্তর্জাতিকভাবে আলি জামান সিরিয়া, মালয়েশিয়া, ইরাক ও তুরস্কে থুলুৎ ও নাসখ লিপিতে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০২০ সালে তিনি বিভিন্ন প্রখ্যাত গুরুদের কাছ থেকে ইজাজাহ গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে তুরস্কের আন্তর্জাতিক হিল্যায়-ই-শেরিফ প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রপতি এরদোগানের হাত থেকে প্রেস্টিজ পুরস্কার লাভ করেন।

জামান বলেছেন, খুব কম মানুষই এমন কিছু করতে পারে এবং তা করার আনন্দ ও গৌরব অন্যরকম। তার ছেলে রেকার জামান জানিয়েছেন, তুরস্কে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়, এজন্য বাবার পরিবার ২০১৭ সালে সেখানে আসে। ইরাকে সেই সুযোগ ও স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়নি। তুরস্কে এসে আলি জামান তার স্বপ্ন—বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরআন লেখা—সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণ করেন।

২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প শুরু হয়। আগের বৃহৎ কোরআনের পাণ্ডুলিপির দৈর্ঘ্য ছিল ২.২৮ মিটার এবং প্রস্থ ১.৫৫ মিটার। জামানের রেকর্ড গড়া কোরআনের দৈর্ঘ্য ৪ মিটার, প্রস্থ ১.৫ মিটার এবং খোলা অবস্থায় ৩ মিটার। যারা পাণ্ডুলিপি তৈরির ঘরে যান, তারা বিস্ময়ে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যান। একজন মাদরাসার শিক্ষক বিস্ময়ে বললেন, ‘মাশাল্লাহ’, এবং ছাত্ররাও অভিভূত হয়ে বাবা আলি জামানকে অভিনন্দন জানান।

জামান ও তার পরিবার কোরআনটি আগুন বা ছেঁড়া থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি প্রদর্শন ও শিক্ষার জন্য ব্যবহারের পরিকল্পনা করছেন। তবে স্থায়ীভাবে এটি তুরস্কে রাখা হবে নাকি অন্য কোথাও নেওয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

আলি জামান বলেন, “কোরআন অত্যন্ত মূল্যবান; উসমানীয় যুগে ক্যালিগ্রাফিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। তুরস্কে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। আমরা আশা করি, এটি এখানে থাকবে এবং দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করবে।”

বিডি/এএন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement