এবার কর ফাঁকির ‘নাম্বার ওয়ান’ সাকিব

এবার কর ফাঁকির ‘নাম্বার ওয়ান’ সাকিব ছবি: সংগৃহীত

বিজনেস ডেইলি ডেস্ক

Published : ১০:১৯, ৮ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একজন সাকিব আল হাসান। দীর্ঘ দুই দশকের ক্যারিয়ারে তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

২০০৯ সালে ‘উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালামনাক’ তাঁকে বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে ২০১০–২০ দশকে একদিনের ক্রিকেটের সেরা ক্রিকেটার হিসেবেও তাঁর নাম ঘোষিত হয়।

নিঃসন্দেহে এ অর্জন সাকিবের ব্যক্তিগত গৌরবের পাশাপাশি পুরো জাতির জন্যও এক গর্বের বিষয়। তবে মাঠের এই তারকার সাফল্যের আড়ালে রয়েছে নানা বিতর্ক, সমালোচনা ও আর্থিক কেলেঙ্কারি, যা তাঁকে বারবার আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে।

খেলোয়াড় জীবনে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছেন সাকিব। কখনো মাঠে রাগান্বিত আচরণ, কখনো প্রশাসনিক জটিলতা, আবার কখনো বিনিয়োগ বা রাজনীতি, সব মিলিয়ে তাঁর নামের সঙ্গে বিতর্ক যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে।

খেলাধুলার পাশাপাশি রাজনীতিতে নাম লেখানো, ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হওয়া এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। তবে এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে তাঁর কর ফাঁকির অভিযোগ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর তদন্ত ও গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাকিবের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ ১০৬ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে কর ফাঁকির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকায়। তদন্তে দেখা গেছে, ব্যাংক আমানত, এফডিআর, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, বিদেশি লিগ থেকে আয়, এমনকি পুরস্কারের টাকাও তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে আইপিএল শুরুর পর থেকেই সাকিব বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে নিয়মিত খেলছেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল), বিগ ব্যাশ লিগ, মেজর লিগ ক্রিকেট—সব জায়গাতেই তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু এসব লিগ থেকে উপার্জিত আয়ের কোনো তথ্যই কর নথিতে নেই।

তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানাচ্ছেন, ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে সাকিবের এফডিআরের পরিমাণ কমতে শুরু করে, যা দেখে সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি হয়তো কিছু অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিয়েছেন। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে তাঁর একটি বাড়ি থাকার প্রমাণও মিলেছে, যেখানে গত বছর বাংলাদেশ দলের কয়েকজন ক্রিকেটার অবস্থান করেছিলেন।

এছাড়া, তাঁর নামে থাকা কোম্পানি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তালিকাও তদন্তে বিস্ময় জাগিয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পাওয়া গেছে, যদিও কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে মাত্র ৯টির। অনেকগুলো কোম্পানির নিবন্ধন একই ছোট অফিস ঠিকানায় করা হয়েছে, যা শেয়ার ব্যবসা ও বিনিয়োগে জটিলতার ইঙ্গিত দেয়।

শেয়ারবাজারে তাঁর বিনিয়োগেরও বড় অংশ গোপন ছিল। একটি সিকিউরিটিজ হাউসের তথ্য অনুযায়ী, সাকিবের প্রকৃত বিনিয়োগ দেখানো অঙ্কের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এমনকি রাজধানীতে কোটি টাকার ফ্ল্যাট কেনার তথ্যও আয়কর নথিতে পাওয়া যায়নি।

২০১৮ সালে রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর সাকিব আওয়ামী লীগের টিকিটে মাগুরা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ক্রিকেটে মনোযোগ ফেরানোর ঘোষণা দেন। তবে রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, বিতর্কিত মন্তব্য ও বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে তাঁর নাম বারবার উঠে এসেছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত এই ক্রিকেটার সর্বশেষ গত বছর নভেম্বরে দেশে ফিরেছিলেন বিসিবির সঙ্গে আলোচনা করতে, কিন্তু কোনো সমঝোতা না হওয়ায় আবার দেশ ত্যাগ করেন। তাঁর আইনজীবী বা ঘনিষ্ঠ কেউই কর ফাঁকির অভিযোগে মুখ খুলতে রাজি হননি।

আয়কর তদন্ত ইউনিটের কমিশনার আবদুর রকিব জানান, সাকিবের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, “সাকিবের নামেই আমরা প্রথম তদন্ত ফাইল খুলেছি—এখানেও তিনি ‘নাম্বার ওয়ান’।”

সব মিলিয়ে, মাঠের ‘নাম্বার ওয়ান’ সাকিব এখন আর্থিক অনিয়ম ও কর ফাঁকির তদন্তে ‘নাম্বার ওয়ান’ অভিযুক্ত হিসেবেও আলোচনায়। একসময় ব্যাট-বলে দেশকে গর্বিত করা এই তারকার সামনে এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জ—আইনের কাঠগড়ায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা।

বিডি/এএন

শেয়ার করুনঃ
Advertisement