রংপুরে মাটি ছাড়া সবজির চারা উৎপাদন করেই সফল তাওহীদ

Published : ১৯:৩৫, ৪ অক্টোবর ২০২৫
অভাব নামে শব্দটি পৃথিবীর কোন বিকট শব্দ প্রতিরোধ করতে পারে না। শত ব্যস্ততার মধ্যে অভাব শব্দটি মানুষকে তাড়া করে। ঢাকার ব্যস্ত পোশাক কারখানায় মেশিনের শব্দে ডুবে থেকেও তাওহীদ মিয়ার কানে ভেসে আসত সংসারের অভাব—অভিযোগ। ৬ হাজার টাকা বেতনে কোনো রকমে দিন চললেও হারিয়ে যাচ্ছিল প্রিয়জনদের মুখের হাসি।
স্ত্রী শিমুর চোখে লেগে থাকত দুশ্চিন্তার ছাপ। সব মিলিয়ে ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, এভাবে আর নয়। সাহস করে ফিরে এলেন গ্রামে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু করলেন মাটি ছাড়া চারা উৎপাদন । সেই ছোট স্বপ্নই এখন তাঁকে দিয়েছে নতুন আলো, নতুন জীবন।
যাঁর সংসারে একসময় তিনবেলা ভাতের নিশ্চয়তা ছিল না, সেই তাওহীদ এখন মাসে আয় করছেন ৮০ হাজার টাকা। একই সাথে গ্রামের ১৮ থেকে ২০ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন। পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মিলনপুর গ্রাম। সেখানেই তাওহীদের জন্ম। কাঁচা—পাকা সড়ক ধরে গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়ে নানা সবজির ক্ষেত।
প্রতিটি বাড়িতে হাঁস, মুরগি, ছাগল ও গাভি। পতিত জমিতে শাক—সবজির বাগান। কৃষক—–কৃষাণীরা মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছে। কেউ পরিচর্যা করছেন, কেউ তুলছেন সবজি। তাওহীদ নামে এক ব্যক্তি বাড়ির পাশের নার্সারিতে বসে আছেন। সেখানেই বসে শোনালেন তাঁর সফলতার গল্প। তাওহীদ বলেন, ১৯৯১ সালে তাঁর জন্ম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বড়।
বাবার সামান্য জমিতে কষ্টে চলত সংসার। ২০০৭ সালে এসএসসি পাসের পরই কর্মজীবনে ঢুকে পড়তে হয় তাঁকে। ২০১০ সালে পাশের গ্রামের শিমু বেগমকে বিয়ে করেন। সংসারের খরচ বাড়তেই ঢাকায় পাড়ি জমান। সোয়েটার কারখানায় চাকরি করেছেন দুই বছর। কিন্তু ৬ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে, তবে স্বপ্ন পূরণ হয় না। অভাব ঘনিয়ে আসতেই ভাবলেন জীবন বদলাতে হলে ভিন্ন কিছু করতে হবে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চাকরি ছেড়ে ফিরে এলেন গ্রামে। ২০১৪ সালের মে মাসে বেসরকারি একটি সংস্থার উদ্যোগে আট দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। বিষয় ছিল মাটি ছাড়া সবজির চারা উৎপাদন।
শিখলেন, কীভাবে নারকেলের ছোবড়া, কচুরিপানা, গোবর ও কিছু রাসায়নিক সার মিশিয়ে তৈরি করা যায় কোকোপিট। সেটাই হলো তাঁর ভাগ্য ঘুরিয়ে দেওয়ার মূল উপাদান। ওই বছরের জুনে ১০ শতক জমিতে তৈরি করলেন প্রথম নার্সারি। উৎপাদন করলেন এক লক্ষ সবজির চারা। তিন মাসেই সব বিক্রি হয়ে গেল। আয় হলো ৬০ হাজার টাকা। তাওহীদ বুঝলেন, পথ তিনি ঠিকই বেছে নিয়েছেন। এখন তাঁর দেড় একর জমিতে বিস্তৃত নার্সারি।
মরিচ, বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, পেঁপে, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ নানা সবজির চারা উৎপাদন করা হয়। তাওহীদ বলেন, তাঁর মাসিক আয় এখন গড়ে ৮০ হাজার টাকা, বছরে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। তাঁর নার্সারিতে প্রতিদিন কাজ করছেন ১৮ থেকে ২০ জন নারী—পুরুষ। নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পাশাপাশি তিনি ঘুরিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের আরও অনেকের ভাগ্য। এই আয়ের টাকা দিয়ে ক্রয় করেছে জমি। দুই ছেলে সামিউল ও আব্দুল্লাহ লেখাপড়া করছে।
সংসারে এখন শুধু স্বস্তি নয়, আছে স্বপ্নপূরণের আলোও। পীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা শাহজাহান সরদার বলেন, তাওহীদ একজন সফল মডেল কৃষক। মাটি ছাড়া চারা উৎপাদন পদ্ধতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে চারা মাটিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকে, ফলে ফলনও বেশি হয়।
তাঁর উদ্যোগ দেখে অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। তাওহীদ মিয়া বলেন, প্রথমে অনেকেই সন্দেহ করত এই চারা হবে তো? কিন্তু এখন আমার নার্সারি থেকে হাজার হাজার কৃষক চারা নিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের তরুণ বেকার বসে না থেকে নতুন কিছু করুক। অভাব একদিন না একদিন জয় হবেই।
বিডি/এএন